Quantcast
Viewing all articles
Browse latest Browse all 109

জীবন না মৃত্যু– শীতকাল কার বেশি বন্ধু?

জীবন না মৃত্যু– শীতকাল কার বেশি বন্ধু, এই প্রশ্নের চারায় গত কয়েক বছর জল ঢেলে চলেছি। সে প্রশ্ন ক্রমে বড় হচ্ছে, ইতি-উতি ডালপালা ছড়াচ্ছে। কিন্তু ফুল? না। ফুটছে না। বড়জোর, কাল ছিল ডাল খালি, আজ ভুলে যায় ভরে। নানা ভুল প্রশ্নের ভুল উত্তরে পাওয়া যায় খুশি কোম্পানির গরম জামা। এই যেমন, শীতকাল যদি ফেসবুকে থাকত, কী হতে পারত তার প্রোফাইল পিকচার? কুয়াশা? সাদা চাদর? রঙিন ফুলের সারি? লাল লেপ-তোশক? বিড়ালের হাই তোলা? নাকি রোদ– যা চামড়ার মধ্যে বয়ঃসন্ধিকালের রাগ নিয়ে ঢুকে পড়ে? গ্রীষ্মের সঙ্গে কি তার একমাত্র মিউচুয়াল ফ্রেন্ড– বসন্ত? আইসক্রিমকে কি সে শ্রেণিশত্রু বলে মনে করে? এসি-কে? ‘হোয়াটস অন ইওর মাইন্ড’-এ কী লিখত? একটা উলের বল গড়িয়ে গড়িয়ে আমি বেরিয়ে পড়েছিলাম একদিন বা এই গোছেরই কিছু? জীবনকে গভীর রাতে সে মেসেজ করত, ‘আসছি, অপেক্ষা করুন।’ মৃত্যুকেও ঘুরিয়ে লিখত, ‘অপেক্ষা করুন, আসছি।’ এই এক অদ্ভুত শীতকালের গদ্যভাষা। তাকে ধরতে পারব কতটুকু, কতটুকু পারব যুঝতে? শুধু বুঝি– সে সাধু নয়, চলিত। রাস্তায় রাস্তায়, উলোধুলো ঘুরে বেড়ালেই কি টের পাওয়া যাবে তার ধরনধারণ? গরমের জামা থেকে যেটুকু বাইরের চামড়া, তাই-ই কি শুধু ঋতু পরিবর্তন টের পাবে? আমাদের মধ্যে কবে থেকে যে ঘাপটি মেরে আছে শীত, কত সালে, কোন তারিখে, কোন মুহূর্ত থেকে, তা কি সুপর্ণা জানে?

Image may be NSFW.
Clik here to view.
No photo description available.
ছবিসূত্র: ইন্টারনেট

এই সেদিন পিজি হাসপাতালের সামনে যে দু’জন বাসে উঠল, তাদের আগে কখনও এ বাসে দেখিনি। বয়স তিরিশ ছুঁইছুঁই। কিংবা সদ্য তিরিশ পেরিয়েছে। মেয়েটির চোখে তিনভাগ জল, একভাগ দেখা। দূরের সিট থেকেও স্পষ্ট সেই জলের ভাষা। কী দেখছে? নিশ্চিত করে জানি না। বাসের দরজার দিকে আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকলে যেটুকু চোখে পড়ে রাস্তা। রাস্তাই খুঁজছে হয়তো। ছেলেটি মেয়েটির ভাঙা খোঁপায় হাত বোলাচ্ছে। সান্ত্বনাবিষয়ক হাত। হাত, সত্যিই তো, উপশম হতে পারত শীতে। কিন্তু ভাঙা খোঁপা, চুলের ঘনত্ব– এই সমস্ত কিছুই প্রবেশ করতে দিচ্ছে না সেই হাতকে, মেয়েটির মনের ভিতরে। চিড়িয়াখানার স্টপে আচমকা সিগনাল– ফলে বাসের ব্রেকে, ঝাঁকুনিতে, মেয়েটির চোখ থেকে ঝরে পড়ল জল। দুঃখ থেকে যে-জল আসে চোখে, সে-ও মেনে চলে জলের ধর্ম। তবে এইবেলা শান্তি পেল যেন ছেলেটি। গাল মুছিয়ে দিল, চোখের তলাও। ছেলেটির হাতে শুকিয়ে যাচ্ছে সঙ্গিনীর অশ্রুনদী। আপনারা কি জানেন, শীত যে পাত্রে জল খায়, তার নাম চোখ? সেই চোখের জলের তাপমাত্রা কত? এই রাতের হিমেল হাওয়া মিশে আছে তাতে? কেউ মারা গিয়েছে কি ওদের? না আহত? ফেরার আর কোনও পথ নেই? ওদের বাচ্চা-কাচ্চার কিছু হল? বাইরের হাওয়া এসে বারবার চোখে ফেলে দিয়ে যাচ্ছে কপালের চিন্তা। সরিয়ে ফেলছি। কারণ, ওরা তো আত্মীয়স্বজন নয়, চিনি না, মিনিট ১৫-এর সহযাত্রী। তবু এই শীতের হাওয়া পেয়ারা-বেতের মতো এসে পড়ছে শরীরে। শাস্তি! শাস্তি এই যে, এই টুকরো স্মৃতিখানা ঝরাপাতার মতো মাথার চারপাশে ক’দিন ঘুরে বেড়াবে। আর সেই ভারতীয় গল্পরীতির মতো ‘তারপর কী, তারপর?’ খুঁজে চলব এই হাওয়া-বাতাসে, যার উত্তর পাব না কখনও। এই উত্তর পেলেই হয়তো জানা হয়ে যেত, শীত কার বন্ধুতম, জীবনের না মৃত্যুর। যতদিন জানব না, মনে হবে, ‘দস্তানা জোড়ার শুধু একটিই কুড়িয়ে পেয়েছি।’ (হোসাই ওজাকির আধুনিক হাইকু)

Image may be NSFW.
Clik here to view.
অলংকরণ: দীপঙ্কর ভৌমিক

যে দৈত্য শীতের সকালে রোজ মর্নিং ওয়াকে বেরয়, তার নাম কুয়াশা। তার বীভৎস খিদে। গাছ খায়, মানুষ খায়, বাড়িঘর, বড়রাস্তা, অন্ধগলি, যানবাহন খায়। একটা দীর্ঘ সাদা পর্দা, যা যে কোনও সিনেমার পর্দার চেয়ে বড়। যার মধ্যে দিয়ে হাঁটলে শরীর দু’চার লহমায় ভিজে যেতে পারে। কুয়াশায় আকাশ ও মাটির সীমারেখা ধুয়ে-মুছে যায়– মনে করিয়ে দিয়েছেন হান কাং, তাঁর ‘দ্য হোয়াইট বুক’-এ। ‘ফগ’ নামের ছোট্ট একটি গদ্যে। লিখছেন, ‘খুব ভোরবেলা এই শহরের ভূতেরাও কি জড়িয়ে নেয় মাফলার?’ কিন্তু এইসব আশ্চর্য কাব্যচিহ্নর পরেও অবধারিতভাবে মনে পড়ছে, ফগ-এর একেবারে শুরুর বাক্য– ‘কেন এই অপরিচিত শহরে পুরনো স্মৃতিগুলো ভেসে ওঠতে থাকে অনবরত?’

Image may be NSFW.
Clik here to view.
নোবেলজয়ী হান কাং-এর ‘দ্য হোয়াইট বুক’

কুয়াশার ওই বড়, অতি বড় পর্দা, তবে কি বিগত দিনের আত্মকাহিনিচিত্রর জন্যই? কিন্তু এই স্মৃতিও কি বড় পাওয়া নয়? ইয়োকো ওগাওয়া-র ‘মেমরি পুলিস’-এ জাপানের অজ্ঞাত দ্বীপে ক্রমশ স্মৃতি হারাচ্ছিল মানুষেরা। তাদের কাছে স্মৃতি ফেরানোর ওষুধ কি তবে অপরিচিত শহরে যখন শীত ঢুকছে, তখন এসে পড়া? হয়তো খানিক মনে পড়বে, অনেকটাই পড়বে না। কিন্তু যোগবিয়োগে ভেসে উঠবে ছেঁড়া কথারা, যা দূরপাল্লার কোনও এক ট্রেনে আমরা হারিয়ে ফেরেছিলাম। তবু কি বলা যাবে না, ‘কুয়াশায় যা পেয়েছি তাও তো অনেক/ যথেষ্ট, যথেষ্ট’? (শক্তি চট্টোপাধ্যায়) এই গদ্য পড়ার পর মনে হতে থাকে, এই কলকাতাও আমার অপরিচিত। সে যতই হেঁটে বেড়াই, উড়ে বেড়াই, সারাদিনমান ঘুরে বেড়াই। যেভাবে ভাস্কর চক্রবর্তী লিখেছিলেন, ‘–বাস থেকে নেমে মনে হল/ বিদেশেই আছি।’ শহরের অপরিচিতিই তো বিদেশ। সেই বিদেশে কি শীতকাল ছড়িয়ে দেয় ফেলে আসা স্মৃতি, যাতে বিদেশের সঙ্গে একটু একটু করে মিলমিশ খেয়ে যায় আজকের আমি?

…………………………………………

আরও পড়ুন কবীর সুমন-র লেখা: ‘আমার গানে গুরুচণ্ডালি, তোর আগে কেউ বলেনি’, বলেছিলেন সলিলদা

…………………………………………

উত্তর কলকাতার সম্ভ্রান্ত পাড়া থেকে পালিয়েছে মেয়েটি, নাম ইলা। পাড়ার উৎকর্ণ লোকজন, বাড়িওয়ালাকে বলা হয়– মাসির বাড়ি, পড়তে গিয়েছে। সত্যি জানাজানি হয়। তবু গোঁ ধরে বসে থাকে ইলার বাবা-মা। বলে, আসবে ঠিক, বড়দিনে। সেই বড়দিন আসে, বড় দিনটি আসে না। কিন্তু সেই অপেক্ষারত শীতরাতে, ইলার বাবা বলে উঠেছিল, ‘সারা জীবনই কেমন ভয়ে ভয়ে কাটল।’ ইলার মা বলেছিল, ‘ভেবেছিলুম কোনো না কোনোদিন ভয় কেটে যাবে।’

Image may be NSFW.
Clik here to view.
ময়দানে শীতকাল

গল্পের নাম ‘শীত’। শীতকে এখানে ছাপিয়ে যায় শৈত্য। যে কোনও ঋতুতেই এ গল্প পড়লে শীত করে। লিখেছিলেন মতি নন্দী। জীবনে বেশ কয়েকবার গোহারান হেরে যাওয়া যে খরখরে নিমপাতা-সত্যি, তা বড়দের গল্পে-উপন্যাসে তিনি দেখিয়েছেন। ভয় আর অপমানের বাটখারা ক্রমে আমাদের দাঁড়িপাল্লায় জাঁকিয়ে বসে। ঘুরে, সেই ভয়ের চোয়ালে ঘুসি মারতে পারি না আমরা কোনও কালেই। এড়িয়েও যেতে পারি না। তাদের রোয়াবে, থ্রেট কালচারে আমাদের শীত করতে থাকে, শীতের রোদের মতো বাঁচা হয়ে ওঠে না আর।

বুকের ভেতরে, সারাজীবন ধরেই দুলতে থাকে একটি ব্যক্তিগত ক্যালেন্ডার, দুলতে দুলতে তৈরি করে ক্ষত। আপনারা নিশ্চিত জানেন, সেই ক্যালেন্ডারের সমস্ত তারিখই শীতকালের।

…………………………………………

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

…………………………………………

The post জীবন না মৃত্যু– শীতকাল কার বেশি বন্ধু? appeared first on Robbar | Sangbad Pratidin.


Viewing all articles
Browse latest Browse all 109

Trending Articles