Quantcast
Viewing all articles
Browse latest Browse all 109

আমাদের পূর্বস্মৃতি বা বিস্মৃতি নিয়েই অনেকটা গড়ে উঠেছে পরশুরামের গল্পের ভূত

জল জমে যেমন বরফ হয়, অন্ধকার জমে জমে তেমনি ভূত হয়। ত্রৈলোক্যনাথ এই আশ্চর্য ভৌত বিজ্ঞানটি আমাদের শিখিয়েছিলেন। সে অন্ধকার এক অর্থে না-জানা, কম-জানার অন্ধকার। আর এক অর্থে, সেই অন্ধকার, এই অসম্ভব দ্রুত পরিবর্তনশীল চারপাশে, ভুলে যাওয়ার অন্ধকার। যে-সব পরিবেশ, যে-সব চরিত্র আজ আমাদের বহু পূর্ব স্মৃতি, কিংবা বিস্মৃতিসম পরশুরামের ভূত-ভুবনের অনেকটাই তাদেরই দখলে।

Image may be NSFW.
Clik here to view.

গত শতকের পাঁচের দশকের একেবারে শুরুর দিল্লির বাঙালিপাড়ার একটি ছবি যেমন, ‘নূতন দিল্লীর গোল মার্কেটের পিছনে কুচা চমৌকিরাম নামে একটি গলি আছে। এই গলির মোড়েই কালীবাবুর বিখ্যাত দোকান ক্যালকাটা টি কেবিন। এখানে চা, বিস্কুট, সস্তা কেক, সিগারেট, চুরুট আর বাংলা পান পাওয়া যায়, তামাকের ব্যবস্থা আর গোটাকতক হুঁকাও আছে। দু’-এক মাইলের মধ্যে যেসব অল্পবিত্ত বাঙালী বাস করেন তাঁদের অনেকে কালীবাবুর দোকানে চা খেতে আসেন। সন্ধ্যার সময় খুব লোক সমাগম হয় এবং জাঁকিয়ে আড্ডা বসে। পৌষ মাস পড়েছে, সন্ধ্যা সাড়ে ছটা, বাইরে খুব ঠান্ডা। কিন্তু কালীবাবুর টি কেবিন বেশ গরম। ঘরটি ছোট, একদিকে চায়ের উনুন জ্বলছে, পনের-ষোল জন পিপাসু ঘেষাঘেষি করে বসেছেন। সিগারেট চুরুট আর তামাকের ধোঁয়ায় ঘরের ভিতর ঝাপসা হয়ে গেছে।’

এই পরিবেশ তৈরি হচ্ছে জটাধর বক্সী গল্পে। সে গল্পের ভূত কিংবা না-ভূতকে আমরা সহজেই চিনি, কিন্তু এই পরিবেশটাও তো আজ ভূতই। ‘ভূশণ্ডীর মাঠে’র চরিত্রগুলিও ভূত, আমাদের চেনা স্বভাবের লোক বলেই মনে হয় তাদের। কিন্তু যে পরিবেশে তারা জীবনোত্তর জীবন যাপন করে সত্যিই কি আজও তা আমাদের চেনা? শিবু হয়তো এখনও টিকিতে ফুল বাঁধে, নাদু মল্লিক এবং কারিয়া পিরেত ধূমপান করে, পেত্নী গোবরজল ছড়া দেয়। কিন্তু তাদের জীবনযাপনের মাঠটাই তো আজ প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে, ভূত হয়ে যাচ্ছে। ‘মহেশের মহাযাত্রা’য় মহেশ অঙ্ক দিয়ে ভূতের না-থাকা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, তারপর আলোকে যে লোপ করে খায় সেই কুয়াশাতেই তাঁকে যেন লোপ করে খেলো। ভূতের অস্তিত্ব প্রমাণের চ্যালেঞ্জ নিয়ে যে পরিবেশে মহেশ মিত্তির আর হরিনাথ কুণ্ডু মানিকতলায় গেলেন তা-ও আজ ভূত–

‘‘শিব-চতুর্দশীর রাত্রে মহেশ মিত্তির আর হরিনাথ কুন্ডু মানিকতলায় গেলেন। জায়গাটা তখন বড়ই ভীষণ ছিল, রাস্তায় আলো নেই, দু’ধারে বাবলা গাছে আরও অন্ধকার করেছে। সমস্ত নিস্তব্ধ, কেবল মাঝে মাঝে প্যাঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে। হোঁচট খেতে খেতে দু’জনে নতুন খালের ধারে পৌঁছলেন। বছর-দুই আগে ওখানে প্লেগের হাসপাতাল ছিল, এখনও তার গোটাকতক খুঁটি দাঁড়িয়ে আছে। মহেশ মিত্তির অবিশ্বাসী সাহসী লোক, কিন্তু তাঁরও গা ছমছম করতে লাগল। হরিনাথ সারা রাস্তা কেবল ভূতের কথাই কয়েছেন– তারা দেখতে কেমন, মেজাজ কেমন, কি খায়, কি পরে। দেবতারা হচ্ছেন উদার প্রকৃতি দিলদরিয়া, কেউ তাঁদের না মানলেও বড় একটা কেয়ার করেন না। কিন্তু অপদেবতারা পদবীতে খাটো ব’লে তাঁদের আত্মসম্মানবোধ বড়ই উগ্র, না মানলে ঘাড় ধরে তাঁদের মান, মর্যাদা আদায় করেন। এই সব কথা।’’

১৯৩০-এ লেখা এই গল্পে মহেশের অন্তিমযাত্রার বর্ণনা ছায়া ফেলে যাচ্ছে ১৯৯০-এর ঘোস্ট সিনেমাতেও, নিজেদের কালো পোশাকপরা বাহন লাগিয়ে নিয়ে চলে গেলো প্রেতলোক।  ওই আলো-আঁধারি কলকাতার মায়া এখনও বড় করুণ স্মৃতির মতো জাগায় অনেককে, পরশুরামের গল্পে সেই ভূত কলকাতার খণ্ড খণ্ড স্কেচ আঁকা আছে বার বার।

Image may be NSFW.
Clik here to view.

প্রমথনাথ বিশী একবার বলেছিলেন ত্রৈলোক্যনাথের গল্পে হাস্যরসের অশ্রুর দিকটা, আর পরশুরামের গল্পে তার তিরস্কারের দিকটা। মনীষীবচন শিরোধার্য, কিন্তু পরশুরামের গল্পগুলি আজও পড়লে একটা হারিয়ে যাওয়া দিনের বেদনা টনটন করে ওঠে। পরশুরামের বর্ণনা আর যতীন সেনের রেখায় সেই দিনগুলোর ছবি আজও এই হেমন্তের দিনে হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগায়।

‘বদন চৌধুরীর শোকসভা’য় হাজির হল যমদূত-সহ দুই ভূত। বদন চৌধুরী বেঁচে থাকতে সমাজসেবা করতেন। তাঁর শোকসভায় বিশুদ্ধ স্তাবকতা হল। কিন্তু বিজ্ঞানী পরশুরাম সেখানে নিয়ে এসেছেন প্রেতদের যারা শোক-টোকের ঊর্ধ্বে। সভার কিছু লোকের ওপর ভর করে তারা জানাল যে বদন চৌধুরী নামের ওই হিতৈষী প্রদীপের নীচে অনেক অন্ধকার। এই অন্ধকারে পরশুরাম তাঁর ব্যঙ্গের তীরটি ছুড়লেন।

Image may be NSFW.
Clik here to view.

কল্পবিজ্ঞানের সঙ্গেও ভৌতিকতাকে মিশিয়েছেন পরশুরাম– সে সব গল্প ভূতের নয়, ভবিষ্যতের। ‘গামানুষ জাতির কথা’ গল্পের শুরুই হচ্ছে এমন এক সময়ে যখন আণবিক বিস্ফোরণে মনুষ্যজাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। বেঁচে আছে কারা? কয়েকটি ইঁদুরমাত্র, গামা রশ্মির প্রভাবে তারা সব চরিত্র মানুষেরই পেয়ে গিয়েছে। ৩০ বছরেই ঘটে গিয়েছে এই বিবর্তন। এই সব গামানুষদের চরিত্র, সমাজব্যবস্থা, রাজনীতি, সবকিছুই সেই ধ্বংস হওয়া মানুষদের মতোই।  তারপর তাদের সব রাষ্ট্রনায়ক মিলেমিশে আলোচনা শুরু করলেন গামানুষ জাতির উন্নতিকল্পে যথাকর্তব্য নিয়ে। তাঁদের আলোচনা ক্রমে আমাদের এখনকার সান্ধ্য চিভি-তর্কের হট্টগোল ও ঝগড়ায় পর্যবসিত হল এবং আর এক বোমার বিস্ফোরণে সবকিছুর ধ্বংস হল। তার পরে পরশুরাম লিখছেন,

মৃতবৎসা বসুন্ধরা একটু জিরিয়ে নেবেন, তার পর আবার স-সত্ত্বা হবেন। দুরাত্মা আর অকর্মণ্য সন্তানের বিলোপে তাঁর দুঃখ নেই। কাল নিরবধি, পৃথিবীও বিপুলা। তিনি অলসগমনা, দশ-বিশ লক্ষ বৎসরে তাঁর ধৈর্যচ্যুতি হবে না, সুপ্রজাবতী হবার আশায় তিনি বার বার গর্ভধারণ করবেন।

পরশুরামের অপ্রাকৃত গল্পগুলি শুধু ভূত-দিনের স্মৃতিই নয়, ভবিষ্যৎ-দিনের অরূপকল্প আশাও।

ছবিঋণ ভিশনস অ্যান্ড ভিস্যুয়ালস: যতীন্দ্রকুমার সেন’স ইলাস্ট্রেশনস ফর পরশুরাম স্টোরিজ, নিয়োগী বুকস

The post আমাদের পূর্বস্মৃতি বা বিস্মৃতি নিয়েই অনেকটা গড়ে উঠেছে পরশুরামের গল্পের ভূত appeared first on Robbar | Sangbad Pratidin.


Viewing all articles
Browse latest Browse all 109

Trending Articles