Quantcast
Channel: পাঁচমিশালি Archives - Robbar | Sangbad Pratidin
Viewing all articles
Browse latest Browse all 113

গ্রামীণ মেয়েদের গ্রীষ্মদুপুরের আড্ডা কি চিরতরে হারিয়েছে?

$
0
0
বাংলার প্রাচীন গ্রাম্যজীবনকে ঘিরে রেখেছে নানা রঙের স্মৃতির নিয়ন আলো। সেগুলোর খোঁজ করতে গিয়েই পথ হারিয়ে ফেলা বারে বারে। মেঠো গ্রামীণ জীবনের আঞ্চলিকতার পরিধি ছিল অন্যরকমের ভালোলাগা মাখানো। সেই ভালোলাগার মধ্যে ছিল মাঠভরা কৃষির ফসল, তরু-তমালের কালো ছায়া, হিজলের লাল ফুলের তোড়া, পারুল বনের গভীরে কাঞ্চনের গাছ। সে গাছ ছুঁয়ে উঠে গিয়েছে মাধবীকুঞ্জ আকাশের পথে! ভূমিপম্পাই ফুলবেড়ে ঘিরে থাকা খামারে চিরসবুজের বনে ফুলের মেলা। মায়ামাধুর্যের এই বাংলার গ্রীষ্মের উঠোনে এভাবেই খেলতে থাকত আম, গাব, জাম, জামরুলের দল। কাঞ্চন, কাঁঠালিচাঁপার ডালে ডালে প্রকৃতিসজ্জার সমাহার। দূরে তালদিঘির ঘন ভোমর কালো জলে পদ্মপাতার ফাঁকে পদ্মফুলের হেলদোল। মনকেমনের এই ধু ধু দুপুরবেলা, মজা পুকুরের শেষ জলটুকুতে উল্টো ডিগবাজি দেওয়া, পাঁকে জল ঘোলা হলে প্রতিবেশীদের গালিগালাজ। কলার ভেলায় ভেসে পদ্মপুকুরে স্নান, সেই সময়ই গ্রামের বড়ঘরের মেঝেতে, রান্নাঘরের চালায়, হেঁশেলের চাতালে কিংবা বড় উঠোনের ছায়া-শীতল দাওয়াতে বসে চলত মহিলামহলের আড্ডা, গান, গল্পের আসর। চলত কূটকচালিও।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সেই মহিলামহলের দীর্ঘ গ্রীষ্মকালের আড্ডায় ছিল আম, তেঁতুল, আনারস, জাম মাখা খাওয়া আর গল্প সৃষ্টি করার অফুরন্ত সময়। কেউ কেউ গল্পের সেই আসরে বসেই বুনতেন আসন, ব্যাগপত্র, কেউ তৈরি করতেন পাখা, কেউ উলের কাঁটা দিয়ে ঘর সাজানো জিনিসপত্র। প্রাচীন বাংলার মহিলারা তাঁতবোনার কাজ করতেন অনেকে। বর্ধমানের দেরিয়াপুরের পাশাপাশি বাঁকুড়ার বিকনার ডোকরা পাড়ার মহিলামহলে এই সময় ধুনো পুড়িয়ে বসে বসে ডোকরার গহনার ছাঁচ তৈরি করে এখনও কেউ কেউ। গ্রীষ্মের এই আলসে দুপুরে এখনও বহু গ্রামে অন্ত্যজ শ্রেণির মহিলার দল বসে কাদা মাখিয়ে ছেলেখেলা পুতুল বানায়।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বহু গ্রামে সেই আড্ডার আসর ছিল চমকে দেওয়ার মতো। আমাদের মধ্যরাঢ়ের গ্রামগুলোয় এভাবেই বসত গ্রীষ্মের গনগনে দুপুরে খাওয়াদাওয়া শেষে নিবিড় আড্ডার আসর। মাদুর, শীতলপাটি তালাই পেতে, সাজা পান মুখে দিয়ে সেই আড্ডায় জড়ো হতেন মহিলার দল। সকাল থেকে দীর্ঘ কাজের শেষে খাওয়াদাওয়া আর তারপর বাসনকোসন ধোয়া হয়ে গেলেই শুরু হত মহিলামহলের সেইসব আড্ডা। পাড়ায় পাড়ায় সেই আড্ডা বসত। জাতির মহিলারা একত্রিত হত কোথাও। কোথাওবা বড় পরিবারের সকলে একত্রিত হত।
লকডাউনেও যে আড্ডা ছিল অবধারিত, তা হারাল কেন? ছবিসূত্র: ইন্টারনেট
সেই মহিলামহলের দীর্ঘ গ্রীষ্মকালের আড্ডায় ছিল আম, তেঁতুল, আনারস, জাম মাখা খাওয়া আর গল্প সৃষ্টি করার অফুরন্ত সময়। কেউ কেউ গল্পের সেই আসরে বসেই বুনতেন আসন, ব্যাগপত্র, কেউ তৈরি করতেন পাখা, কেউ উলের কাঁটা দিয়ে ঘর সাজানো জিনিসপত্র। প্রাচীন বাংলার মহিলারা তাঁতবোনার কাজ করতেন অনেকে। বর্ধমানের দেরিয়াপুরের পাশাপাশি বাঁকুড়ার বিকনার ডোকরা পাড়ার মহিলামহলে এই সময় ধুনো পুড়িয়ে বসে বসে ডোকরার গহনার ছাঁচ তৈরি করে এখনও কেউ কেউ। গ্রীষ্মের এই আলসে দুপুরে এখনও বহু গ্রামে অন্ত্যজ শ্রেণির মহিলার দল বসে কাদা মাখিয়ে ছেলেখেলা পুতুল বানায়। বাঁকুড়ার হাটগ্রামের মহিলামহলে এই সময় তোড়জোড় থাকে পুজোর জন্য তৈরি শাঁখার পালিশ করতে। বীরভূমের কুড়মিঠা, কেন্দুলী, ষাটপলসা, শিমুলিয়া এবং ময়নাডালের মতো গ্রামে এই অলস দুপুরে মহিলাদের দল গৃহস্থের কাজ বাগিয়ে বসে পদাবলি কীর্তনের চর্চায়। বাঁকুড়ার বহু গ্রামে এখনও দুপুরে, রাতের ঠেকে বসে মহিলাদের দল চর্চা করেন রামায়ণ গানের। পূর্ব-বর্ধমানের পাশাপাশি জলপাইগুড়ি, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুরের বহু গ্রামের মহিলামহলের আসরে এখনও বেতের কাজ হয় নিয়ম করে। রাঢ়ের বহু মহল্লায় বাঁশশিল্পের পাশাপাশি মহিলাদের আড্ডার ঠেককে আলোকিত করে রেখেছে তাল ও খেজুর পাতার তালাই তৈরি করার কাজ।
মা-ঠাকুমাদের স্টাইলে বানান কাঁচা আমের ছেঁচকি – TV9Bangla
বর্ষার আগে গ্রীষ্মের এই দুপুরবেলা জুড়ে রাঢ়ের অনেক বাউড়ি-বাগদি পাড়ার মহিলামহলে বসে মাছ ধরার ঘুণির কাঠি তৈরি করার কাজ। সেই আড্ডা মহলে তাসের বিন্তি, টোয়েন্টি নাইন খেলা ছিল বেশ জনপ্রিয়। তাঁদের অনেককে মাঠ থেকে তুলে এনে শসা খেতে দেখেছি নুন-লঙ্কা মাখিয়ে। কেউ কেউ পাকা টমেটো নুন, লঙ্কা দিয়ে কচুপাতায় মেখেও খান। আড্ডা জমে উঠলে কাঁচা আম, গুড়, লঙ্কা, নুন, তেল মেখে থেঁতলে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল বহুদিন। তাঁদের অনেকে নিয়ম করে আড্ডার আসরে তাল ও খেজুর পাতার তালাই বুনতেন। আদিবাসীদের পাড়ায় পাড়ায় জঙ্গল থেকে তুলে আনা কাঁচা শাল পাতা শুকিয়ে, তা দিয়ে, কুঁচির কাঠিতে গেঁথে পাতা তৈরি করতেন। মোলের বীজ কুড়িয়ে এনে অনেকে আড্ডার আসরে খোসা তুলতেন। তা দিয়ে নাকি তেল তৈরি হয়। তবে অনেক সাধারণ পরিবারের মহিলামহলেও সেকালে কেউ কেউ রামায়ণ, মহাভারত পড়তেন সুর করে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
গ্রীষ্মের সেই অসংগঠিত কয়েকটি আড্ডার আসর ছিল আমাদের গ্রামেও। শিক্ষা-দীক্ষায়, চিন্তা-চেতনায়, অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে সেইসব আড্ডামহলের মহিলাদের পৃথক পৃথক ঠেক বসত গ্রামে। তেমনই কয়েকটি না-ভোলা স্মৃতির পাতা থেকে তুলে আনা গ্রামীণ মহিলাদের গ্রীষ্মের ঠেকবাজ দিনের কথা মনে আসছে স্মৃতির বনে, ধূসরতার ক্লান্তি কাটিয়ে। তবে এ শুধু গ্রীষ্মকালেই নয়, এমন আড্ডার আসর বসত গ্রামের মহিলামহলে নিত্যদিন। নির্জন দুপুরে, একাকিত্বের সন্ধেবেলা মহিলামহলের সেই আড্ডার বৈচিত্রময় উপলব্ধি এখনও মনের ভিতরে আঁকা। মহিলাদের সেই আড্ডামহলের রঙিন দিনগুলি ছিল সেকালের উজ্জ্বলতায় ভরা, স্বপ্নের দিন। জীবনকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যেতে চাইলে সামাজিক নিবিড়তায় ভেজা গ্রীষ্মের টক কুল, বাতাবিলেবু মাখা, কাঁচা পেয়ারা মাখা, কামরাঙা মাখা খাওয়ানোর পালা ছিল মহিলাদের নানাজনের। অবসর ছিল না সে আড্ডার বয়স যাপনে!
কূটকচালির আবহাওয়া কাটিয়েও কোথাও যেন মহিলাদের চোখে জেগে উঠত নিজস্ব স্বপ্ন। হীনম্মন্যতায় তেমন ভুগতে দেখতাম না আমার গ্রামের ঠেকবাজ রাঙাঠাকুমা, নারায়ণী, বনতুলসী পিসিকে। তাঁরা বাল্যবিধবা ছিলেন! এককথায় কড়ুইরাঁড়ি। আর সংসার করেননি। জীবনকে গ্রামীণ আড্ডার জগতে প্রতিষ্ঠা দিতে তাঁরা নিজের নিজের জগৎ তৈরি করে নিয়েছিলেন।
রাঙা ঠাকুমা রান্না শেখানোর ভিয়েনশালা বসাতেন ঠেকের দুপুরে কিংবা সন্ধেবেলা। সেখানে তৈরি হত নানারকমের পদ। আর নারায়ণী দিদি গ্রামের মহিলাদের নিয়ে নির্জন দুপুরবেলা শেখাতেন মাটি দিয়ে বরকনে পুতুল তৈরি করতে। বনতুলসী পিসি ভাল উনুন পাততে পারতেন। তাঁর তৈরি উনুনের কদর ছিল সেকালের বাড়ি বাড়ি। পাড়া ছাড়িয়ে ভিন্ন পাড়া থেকেও মহিলাদের দল আসত তাঁর থেকে উনুন পাতা শিখতে।
গ্রামীণ মহিলাদের স্মৃতির সেইসব হারিয়ে যাওয়া আড্ডার সকাল-বিকাল ছিল আমার ছেলেবেলার দৃশ্যপট। এখন হয়তো সবই ইতিহাস। মলিন আধুনিকতার ধুলোয় ঢাকা পড়ে গিয়েছে, সেই ধুলো সরিয়ে আবারও কি দেখা পাওয়া যাবে তাঁদের?

The post গ্রামীণ মেয়েদের গ্রীষ্মদুপুরের আড্ডা কি চিরতরে হারিয়েছে? appeared first on Robbar | Sangbad Pratidin.


Viewing all articles
Browse latest Browse all 113

Trending Articles