আমাদের অবচেতনে একেকটা রঙের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বিচিত্রতর অনুভূতি। তাদের কোনওটা চেনা, কোনওটা আধো-চেনা। কোনওটার বা নাগাল পাওয়া দুষ্কর। যেমন, সাধারণভাবে লাল রঙের সঙ্গে জুড়ে থাকে প্রেমের অ্যাসোসিয়েশন, কামনার ইশারা। অন্যদিকে সে হচ্ছে রক্তের রং, হিংসার রং আবার বিপ্লবেরও।
এই অভিধার বাইরে গিয়ে রঙের সঙ্গে কারও ব্যক্তিগত অবসেশন মিশে যেতে পারে। সেই রঙের অনুভূতি গ্রন্থিবদ্ধ হতে পারে আনন্দ, বেদনা, হতাশা এমনকী তার যৌনতার নিরিখেও। হয়তো এভাবে দৃশ্যরূপের সঙ্গে স্মৃতির অভিজ্ঞতা মিশে গিয়ে এক অর্থবহ ব্যঞ্জনা তৈরি করে। আবার সেই সাধারণ সংজ্ঞার বাইরেও বিস্তার কিছু কম নয়। আবার কোনও একটা রং সব সময় একই অর্থ নিয়ে হাজির হয় না, ক্ষেত্রবিশেষে তার তাৎপর্য বদলে যেতে পারে।
সাদা রঙের কথাই ধরা যাক। সাদার প্রসঙ্গে আমাদের মনে শান্ত, ধীর, পবিত্রতার ভাব জেগে ওঠে। এছাড়াও সেখানে শূন্যতার উপলব্ধি অস্বাভাবিক নয়। অবনীন্দ্রনাথ একবার রঙের বোধ প্রসঙ্গে উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, বিয়ের কনেকে লাল টুকটুকে শাড়িতে কেমন সুন্দর দেখায়, আবার সেই মেয়েই যখন হঠাৎ সাদা থান পরে বাপের বাড়িতে ফিরে আসে, তখন বাবার বুকে কী নিদারুণ আঘাত লাগে! এখানে এই দুটো রঙের মধ্য দিয়েই সমস্ত পরিপ্রেক্ষিত একেবারে স্পষ্ট হয়ে এল। আমাদের অভিজ্ঞতা বুঝিয়ে দিল এই দ্বিতীয় রঙের আড়ালে এক মহাদুর্যোগের উপাখ্যান লেখা আছে। অতএব, রঙের যে বিশেষ অভিব্যক্তি, তা আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি-লোকাচারের সঙ্গেও জড়িয়ে থাকে। শ্বেতশুভ্র কেবল শান্তি আর পবিত্রতার পরিচায়ক নয়, তার সঙ্গে মিশে আছে বিরহ-বিচ্ছেদের করুণ আর্তি। সেদিক থেকে দেখলে, নতুন আবাসের শূন্য শ্বেতস্নাত অন্দরমহলে প্রবেশ করলে আনন্দের সঙ্গে কী এক হাহাকারও জেগে ওঠে। আবার সাদা তো আলোও বটে, ঘনকালো মেঘের গায়ে ঝলসে ওঠা বিদ্যুতের ঝিলিক, ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’র বিপুল উদ্ভাস– অর্থের চেয়ে দৃষ্টির বোধ সেখানে বড়।
এই আলোই কোথাও সাদা হয়ে ফোটে, ‘সহজ পাঠ’-এর পাতায় নন্দলালের ছবির মতো। বা বহুশ্রুত কবিতার সেই ছত্র, যেখানে লেখা– ‘কালো রাতি গেল ঘুচে,/ আলো তারে দিল মুছে’– সে তো সাদা-কালোর সার্বিক দ্বন্দ্ব। কবিতায় অন্ধকার সরিয়ে আলো ফোটার আড়ালে সাদা দিয়ে কালোকে মুছে দেওয়ার যে গভীর অর্থ এখানে রয়ে গেল, সে ব্যঞ্জনাও কম নয়। আসলে রং আর ভাব সর্বদা যেন হাত ধরাধরি করে চলেছে, কেবল দৃশ্যতায় সে আটকা পড়ে না। আমাদের অনুভবের গভীরে প্রোথিত হয়। ভাবের সঙ্গে, অর্থের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে তার গাঁটছড়া বাঁধা। রবি ঠাকুরের গুণী ভাইপো বলেন্দ্রনাথের লেখা মনে পড়ে। তাঁর মতে, ‘বিভিন্ন রঙে যেন স্বতন্ত্র ভাব লুকাইয়া আছে, সুরের মতন ধীরে ধীরে তাহারা প্রাণে আসিয়া আঘাত করে। আমাদের হৃদয়ে নূতন নূতন ভাবের বিকাশ হয়। প্রকৃতিতে ভাববিহীন রঙ নাই– রঙ মাত্রেরই সঙ্গে এক একটা ভাবের বিশেষ রকম যোগ আছে। ঊষার রঙে কেমন একরকম বিমল পবিত্রতার ভাব– সে ভাবে, সংসারের কলঙ্ক কোথাও স্পর্শ করে নাই; সন্ধ্যার রঙে স্নেহমাখা শান্তিময় ভাব– প্রাণ যেন জুড়াইয়া যায়। বাসন্তী রঙে ভাব ঢলঢল টলমল– প্রাণ বদ্ধ থাকিতে পারে না, বাহির হইবার জন্য ব্যাকুল হইয়া ওঠে’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
……………………………..
নিশ্চিতরূপে চিহ্নিত করতে পারি, এখানে মেঘের গায়ে লেগেছে সূর্যাস্তের রক্তিম আভা। সেই পুঞ্জিত মেঘ যেমন তেমন নয়, সে ‘সন্ধ্যার মেঘমালা’। কমলার সীমানা ছাড়িয়ে সে রং লালের প্রান্তভাগ ছুঁয়েছে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় উঠেছে ‘রাঙা’ হয়ে। এ সেই রঙ যা কবিকে বারবার ঠেলে দিয়েছে এক বেদনার্ত অস্থিরতার দিকে।
……………………………..
উপরের অংশে বলেন্দ্রনাথ রঙের অন্দরে ভাবের কথা বললেও প্রত্যক্ষ উচ্চারণ করেছেন কেবল বাসন্তী রঙের। ঊষা ও সন্ধ্যার রঙের বিবরণ না-দিলেও সে রং আমাদের চেনা। এমনি করে রঙের প্রত্যক্ষ উচ্চারণ ছাড়াও তার অস্তিত্ব ঘোষণা করা সম্ভব, যখন সে আমাদের স্মৃতিসিক্ত হয়ে ওঠে। সেখানে অনুচ্চারিত রঙের গোত্রটি বুঝতে অসুবিধা হয় না। এ প্রসঙ্গে আরেকটি কবিতার টুকরো– ‘মেঘের উপর মেঘ জমেছে রঙের উপর রঙ/ মন্দিরেতে কাঁসরঘণ্টা বাজলো ঢং ঢং’। চেনা কবিতা, স্তবকে স্তবকে মেঘের উপর মেঘের জমে ওঠার কথা এসে পড়লেও রঙের প্রত্যক্ষ উচ্চারণ এখানে নেই। কিন্তু পরের ছত্রে মন্দিরের কাঁসরঘণ্টা বেজে ওঠার অভিজ্ঞতা আমাদের জানিয়ে দেয়– সেটি সন্ধ্যারতির সূচনামুহূর্ত। এবং সময় যখন সন্ধ্যা, তখন এক লহমায় চিনে নিতে পারি, অনুচ্চারিত রংটি কী? নিশ্চিতরূপে চিহ্নিত করতে পারি, এখানে মেঘের গায়ে লেগেছে সূর্যাস্তের রক্তিম আভা। সেই পুঞ্জিত মেঘ যেমন তেমন নয়, সে ‘সন্ধ্যার মেঘমালা’। কমলার সীমানা ছাড়িয়ে সে রং লালের প্রান্তভাগ ছুঁয়েছে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় উঠেছে ‘রাঙা’ হয়ে। এ সেই রঙ যা কবিকে বারবার ঠেলে দিয়েছে এক বেদনার্ত অস্থিরতার দিকে।
…………………
পড়ুন লাল রং নিয়ে হিরণ মিত্রের লেখা: সাদা-কালো ক্যানভাসে একদিন লালের ফোঁটা পড়ল, আমার ছবি বদলে গেল তারপর
………………..
সাধারণভাবে কমলা রং হল দিবাবসানের রং, ‘দিনশেষে রাঙামুকুল’ হয়ে সে ফুটে ওঠে। বলেন্দ্রনাথের লেখার সূত্র ধরে একটু অন্যভাবেও বলতে পারি, সন্ধ্যার রঙে ওই ‘স্নেহমাখা শান্তি’র পাশাপাশি সেখানে ঘনিয়ে ওঠে ছায়াঘেরা ক্লান্ত অবসাদ। এই কমলার দীপ্তি প্রদীপশিখার মৃদু আলোকের মতো স্নিগ্ধ অথচ উজ্জ্বল। দিন এবং রাত্রির মাহেন্দ্রক্ষণে এই ছায়াচ্ছন্ন কমলা রঙের আলো মনের মধ্যে বিধুর বিষাদের সঙ্গে অব্যক্ত আনন্দের অনুভূতি জড়িয়ে নেয়। দিনান্তবেলার সেই ম্লানরঙিন মুহূর্তমালা যেন একই সঙ্গে মিলন আর বিরহের দোলাচলে বাঁধা পড়ে।
কমলা রঙের দৃশ্যচেতনা কি এখানেই থেমে থাকে? না, তা নয়। দৃশ্যত কমলা হল আগুনের রঙ। আগুন, যা কি না জীবনের আবর্জনা পুড়িয়ে নিরাসক্ত সন্ন্যাসীর গেরুয়ার সঙ্গে মেশে। অবনীন্দ্রনাথে যে ‘ভারতমাতা’র ছবি আঁকলেন, সেই সন্ন্যাসিনীর পরিধেয় বস্ত্রটি কমলা মিশ্রিত গেরুয়ার প্রলেপে ‘ভারতমাতা’ ছবিকে অন্য স্তরে পৌঁছে দিয়েছে। সাদা রঙের পোশাকে আবৃত হলে এই ছবি হয়তো ধরা দিত সেবিকার প্রতিমায়। তখন ঊষার অরুণালোকে রঞ্জিত ‘ভারতমাতা’র প্রতিমা এমনি করে দেশমাতৃকা হয়ে উঠতেন কি না বলা যায় না।
অন্যত্র দেখি, প্রত্যুষের প্রথম কিরণের মতো কমলার দীপ্তি একতারা হাতে বাউলের গেরুয়া আলখাল্লায় ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ, গেরুয়ার প্রান্ত ছুঁয়ে যাওয়া কমলা রঙে সন্ন্যাসীর ভঙ্গি মিশে আছে। আবার এই নির্লিপ্ত উদাসীনতার বিপরীতেই জেগে যৌবনের অমোঘ মন্ত্র। যেখানে সে রঙ আরও তীব্রতায় নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করতে উদ্যত। জীবনের প্রাণচঞ্চল এই বার্তা সে পেয়েছে প্রকৃতির ভাণ্ডারে। প্রকৃতিতে কমলা যে বসন্তের রঙ– পলাশ, শিমুল, অশোক, মন্দার, রুদ্রপলাশ, গুলমোহর, বসন্তিকা ছুঁয়ে ফাগুন-বৌয়ের স্পর্শকাতর পাপড়ির বুকে তার জয়জাত্রা।
অন্যদিকে দুধসাদা শিউলির বৃন্তে কমলার ছোঁয়ায় সে ফুল কী অনির্বচনীয় শোভা পায়। সত্যিই তাই, প্রকৃতির বাসরে কমলা হল যৌবনের রং, উদ্দামতার রং। আগুনের মতো দাউদাউ করে জ্বলে ওঠার যে রং– সেখানেই কমলার দীপ্র উপস্থিতি। রবীন্দ্রনাথ যে ঘোষণা করেছেন– ‘ওরে পলাশ, ওরে পলাশ,/ রাঙা রঙের শিখায় শিখায়/ দিকে দিকে আগুন জ্বলাস’– সে তো বর্ণে বর্ণে সত্যি।
বিজ্ঞানের প্রেক্ষিতে দেখলে, কমলা রং প্রকৃতপক্ষে লাল এবং হলুদের আনুপাতিক মিশ্রণে তৈরি। এই কারণে, পদার্থবিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুসারে লাল, নীল ও হলুদ– এই তিনটি মূল রং তথা ‘প্রাইমারি কালার’-এর তালিকায় কমলাকে রাখা যায় না। সে হচ্ছে মিশ্র বর্ণ, প্রাথমিক বর্ণের আনুপাতিক মিশ্রণে অন্যান্য রং গড়ে ওঠে। বিজ্ঞানীরা বলেন, প্রত্যেকটি রং-ই পদার্থবিজ্ঞান, মনোপদার্থবিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞানের নিরিখে বিচার্য হয়ে থাকে। সেদিক থেকে রঙের চাক্ষুষ সংবেদন মস্তিষ্কের অনুভূতির মধ্য দিয়ে মনোবিজ্ঞানের অন্দরে স্থায়ী আসন রচনা করে। তবে শিল্পীর ক্যানভাসে রঙের আস্তরণ গড়ে ওঠে পদার্থবিজ্ঞান আর মনোবিজ্ঞান মেলবন্ধনে। শিল্পীদের কারও কাছে রং একান্তই দৃষ্টিজাত উদ্দীপনার সঙ্গে মিশ্রিত, কেউ বা তাকে জড়িয়ে নিতে চান মনোবিজ্ঞানের দ্যোতনায়, পরাবাস্তবের নিরিখে, প্রতীকের আধারে।
রঙের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এবং ফোটোগ্রাফির বিশেষ প্রভাব দেখা যায় শিল্পীদের কাজের ওপরে। এই ব্যাপারে সর্বাগ্রে সাড়া দিয়েছেন ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীরা। রং-কে তাঁরা দৃষ্টিবিজ্ঞানের প্রেক্ষিতে প্রয়োগ করতে চেয়েছেন। এর মধ্য দিয়েই শিল্পকলায় আধুনিক ভাবনার সূত্রপাত। ফরাসি শিল্পী ক্লদ মোনের সেই ‘ইম্প্রেশন সানরাইজ’ ছবিতে দেখি, সূর্যোদয়ের মুহূর্তে আকাশের গায়ে আগুনের মতো কমলা রঙের সূর্যগোলক, আর জলে তার প্রলম্বিত প্রতিফলন– যা তাঁর ছবিকে নতুন আঙ্গিকে ব্যক্ত করেছে। উল্লেখ্য, এখানে প্রধান হয়ে উঠেছে দৃশ্যজাত উদ্দীপনার দিকটি।
Clik here to view.

একই কথা বলতে হয় তাঁর ‘Autumn at Argenteuil’ ছবির ক্যানভাস জুড়ে আগুন ধরানো কমলার পত্রপল্লবিত অরণ্যের দিকে তাকিয়ে। বা ‘Water lilies: Sunset’ ছবির জলে পড়ন্ত সূর্যের ঝলসে ওঠা কমলা রং লক্ষ করে। শিল্পী দেগার স্নানরত নারীর ক্ষেত্রেও তাই, কিন্তু শিল্পী পল গগ্যার তাহিতী দ্বীপের অনাবৃত মেয়েদের শরীরে কমলার নিবিড় প্রলেপ যেন উদ্ধত যৌবনের প্রতীক। সেইসব নগ্নিকার মধ্যে কারও থালায় সাজানো তীব্র কমলা ফুলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তাদের স্তনবৃন্ত উঠেছে রাঙা হয়ে। এ রাঙা লজ্জায় নয়, এখানে চিত্রিত যৌবনের রাঙা অহঙ্কার, কমলা রঙের অমলিন উদ্দীপন এখানে যৌবনের রাঙা মশাল হয়ে উঠেছে।
Clik here to view.

এ ছবি দেখতে দেখতে নির্ঘাত মনে পড়ে যাবে রবীন্দ্রনাথের সেই বহুচর্চিত কবিতা, ‘হঠাৎ কখন সন্ধ্যাবেলায়/ নামহারা ফুল গন্ধ এলায়,/ প্রভাতবেলায় হেলাভরে করে/ অরুণকিরণে তুচ্ছ/ উদ্ধত যত শাখার শিখরে/ রডোডেনড্রন-গুচ্ছ’। এই ছবিতেও সেই চোখধাঁধানো কমলা ফুলের ডালা আর নারী, রঙে আর ব্যঞ্জনায় একেবারে একাকার।
The post সময় যখন সন্ধ্যা, তখন এক লহমায় চিনে নিতে পারি অনুচ্চারিত রংটি কী? appeared first on Robbar | Sangbad Pratidin.