সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রাসমঞ্চে পূজিত হচ্ছেন শতাব্দীপ্রাচীন দেববিগ্রহ। স্থানীয় উৎসাহীরা স্মার্ট ফোনের স্মৃতিতে লেন্সের ঝলকে বন্দি করে রাখছিল সেই আধ্যাত্মিক মুহূর্ত। এমন সময় হঠাৎ আরও একটা প্রস্তুতি চলছিল। আধুনিক ডিজিটাল যুগে দাঁড়িয়ে এক অসম লড়াইয়ের প্রস্তুতি। শেকড় বিচ্ছিন্ন জাতির কাছে ফেলে আসা অতীত যেন নিজেকে প্রমাণ করার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছিল। প্রস্তুতি চলছিল পুতুলনাচের মাধ্যমে পৌরাণিক পালা ‘গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম’।
পালা শুরুর ঠিক আগের মুহূর্ত স্মরণ করা হল মা সরস্বতী, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, রাধাকৃষ্ণকে। মঞ্চতে ধূপকাঠি দেখিয়ে শুরু হল গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম। এ বছর রাস উৎসব উপলক্ষে এমনই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল হাওড়ার ঐতিহ্যশালী বাগুইবাড়িতে। পুতুল-নাচ বাংলার ঐতিহ্যশালী সংস্কৃতির প্রতীক। কিন্তু পাশ্চাত্যমুখী বাজার সর্বস্ব আধুনিকতা নামক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সে ক্রমাগত অসম লড়াই করে চলেছে।
Clik here to view.

১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত নাট্যগোষ্ঠী জ্ঞানদা চক্রবর্তী পুতুলনাচ সংস্থা। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবারের খাকড়াকোনা গ্রাম অবস্থিত এই পুতুলনাচের দল এখনও সমাজের প্রান্তিক শ্রেণিতে থাকা শিল্পীদের নিয়ে এগিয়ে চলছে। পুতুল-নাচ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ৭১ বছর বয়সি শিল্পী সুব্রত বেরা জানিয়েছেন যে, সব রকমের পালাই তাঁরা করে থাকেন। যেমন সামাজিক, পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক। এই তিন রকমের পালা করতে গেলে পুতুলের তিন রকমের পোশাক লাগে। যখন যে নাটকটা হয়, সেই অনুযায়ী পুতুলগুলোকে সজ্জিত করা হয়। চিত্রনাট্য লেখার জন্য বাজার থেকে বই কিনতে হয়। সেগুলো মূলত যাত্রাপালার বই। সেইগুলোকে পুতুলনাচের জন্য পরে উপযোগী করে তুলতে হয়। পুতুলনাচের সঙ্গে গান এবং সংলাপ শিল্পীরা নিজেরাই তৈরি করে থাকেন।
সামাজিক পালা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে শিল্পী বলেন যে, এ ধরনের পালায় জনপ্রিয় ‘চণ্ডীতলার মন্দির’, ‘অভিশপ্ত ফুলশয্যা’, ‘চিতার আগুন জ্বলছে’। পৌরাণিক ক্ষেত্রে জনপ্রিয় পালা ‘মহারাজা হরিশচন্দ্র’, ‘অকাল বোধন’। ঐতিহাসিক পালা এখনও আলো করে থাকে অবিভক্ত বাংলার নবাবরা। যেমন আলিবর্দি, মুর্শিদকুলি খান। আক্ষেপের সুরে সুব্রতবাবু জানালেন, বাংলার মেলার অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে পুতুলনাচ। যতই ড্যান্স, ধামাকা করুন না কেন পুতুলনাচ ছাড়া মেলার কথা ভাবাই যায় না!
সেই মেলাগুলোতে আজ ব্রাত্য পুতুল নাচ। চার দশকের বেশি ধরে পুতুলনাচের সঙ্গে যুক্ত সুব্রত বেরা। কিন্তু স্রেফ পুতুল-নাচ দেখিয়ে আর সংসার চলে না। ফলে রুটিরুজির জন্য টিভি, রেডিও সারাই করে থাকেন। পর্যাপ্ত শোয়ের চাহিদা না থাকার কারণে তরুণ প্রজন্ম এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইছেন না।
Image may be NSFW.
Clik here to view.
পুতুলনাচে ব্যবহার করা পুতুলগুলোকে কেন ‘ড্যাং পুতুল’ বলা হয়? শিল্পী জানিয়েছেন, ‘ড্যাং’ মানে লাঠি। পুতুলের তলার দিকটা লাঠির মতো। সেটা দিয়েই নাচানো হয়। গঙ্গাদূষণও বাদ পড়েনি পুতুলনাচের নাটকের বিষয় হিসেবে। নাম: ‘গঙ্গা নমামী’। এই গঙ্গার সঙ্গে কিন্তু জুড়ে আছে পুতুলনাচের সংস্কৃতি।
গবেষক শুভ জোয়ারদার জানিয়েছেন, পুতুল-নাচ বা পাপেট্রি বলতে আমরা সারা ভারতে ও বিশ্বে যা বুঝি তার উৎস শিকড় ছিল গঙ্গারিডি সভ্যতা। ভারতের পূর্বাঞ্চলে গঙ্গার অববাহিকার রাঢ়বঙ্গে অবস্থিত ছিল এই সভ্যতা। সেখানে নিয়মিত চর্চা হত পুতুলনাচের। গ্রিসের সঙ্গে এই সভ্যতার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। সেই সময় বাংলা তামা, গুড়, গন্ধদ্রব্য, মাটির খেলনা, মশলা, রেশম রফতানি করত গ্রিসে। সেই বাণিজ্যিক সম্পর্কের মাধ্যমেই বাংলা থেকে পুতুলনাচের ঐতিহ্য পৌঁছয় গ্রিসে। পরে গ্রিস থেকেই পুতুল-নাচ সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলে গোটা বিশ্বের পাপেট্রির জন্মস্থান হচ্ছে গঙ্গারিডি সভ্যতা। পুতুলনাচে বৌদ্ধ ধর্মের অবদান প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বর্ষীয়ান গবেষক জানিয়েছেন যে ভারতে বৌদ্ধ যুগই পুতুলনাচের জন্য সুবর্ণ যুগ ছিল। বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারে পুতুল-নাচকে ব্যবহার করা হত। সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সঙ্গে পুতুলনাচের দলকে পাঠাতেন ধর্ম প্রচারের কাজে। এর মাধ্যমেই তৎকালীন জনগণ বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি উৎসাহী হয়ে উঠত। সেই সময় সমাজের অভিজাতবর্গ পুতুলনাচ দেখতেন ও চর্চা করতেন। বেতন দিয়ে আচার্য নিয়োগ করে পুতুল নাচের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হত।
Image may be NSFW.
Clik here to view.
মধ্যযুগে পুতুলনাচ চর্চার অবনতি শুরু হল। ফলে পরবর্তীতে পুতুলনাচ লোকসংস্কৃতির তলায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। পরবর্তীতে অন্যান্য সকল শিল্পধারা লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্র ছেড়ে অভিজাত শ্রেণির আপন হয়ে উঠলেও পুতুলনাচ সেই গৌরব থেকে বঞ্চিত থেকে গেল। তিনি আরও বলেন যে, পুতুল নাটক নিজেই একটা নিজস্ব শিল্পের ধারা। পুতুলনাচে দু’টি জিনিস পাওয়া যায়, তা ‘পুতুল’ ও ‘নাটক’। নাচ তো নাটকের মধ্যে থাকেই। পুতুল যখন আবিষ্কৃত হয় তার পর তাকে সংলাপ ও নাড়িয়ে চাড়িয়ে নাচ ও নাটক করা হয়। যতই উন্নতি হোক লোকমুখে ‘পুতুল নাচ’ই রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে ইউরোপ অনেক এগিয়ে গেলেও এখানে কোনও পরিবর্তন আসেনি। আমরা পুতুলনাচই বলে আসছি। কৃষি যুগের প্রাক্কালে মায়ের হাতে পুতুলের জন্ম হয়। সেই পুতুলকে পরবর্তীকালে নাড়িয়ে চাড়িয়ে তাতে সংলাপ এবং গান ঢুকিয়ে পুতুলনাচের সৃষ্টি হল। সেই নাচ একটা আলাদা শিল্প বা আর্ট ফর্ম।
প্রথমে পুতুল নাচত। তার পর দেহ ভঙ্গিমা করে কসরত দেখাত। তার পরে সংলাপ যোগ করে পালা করতে শুরু করল। পুতুল একটা আলাদা শিল্প তার মধ্যে নাট্যরস যুক্ত হল। দু’টির সন্ধিতে তৈরি হল পুতুলনাচ বা পাপেট্রি বা পুতুল নাটক বা পুতুল পালা। সেই পালা নিজের প্রয়োজনে কখন ঐতিহাসিক, পৌরাণিক পালা করেছে। সারা পৃথিবীতে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে বিনোদন সব থেকে বেশি অগ্রাধিকার পায়। বিনোদন দিয়ে কমিউনিকেট করলে সেটা বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। বিভিন্ন শিল্প ধারার মধ্যে পাপেট্রি দিয়ে মানুষের সঙ্গে দ্রুত কমিউনিকেট বা প্রভাব বিস্তার করা যায়। কিন্তু গোটা বিশ্বে পুতুল নাটক যখন অনেক এগিয়ে গিয়েছে তখন এখনও একই জায়গায় থেকে গিয়েছে ভারতের পুতুল নাচ। সে আজও লোকসংস্কৃতির আঁচলের তলায় থেকে গিয়েছে। বর্তমানে অভিজাত্য সমীহ পাওয়া থেকে বঞ্চিত। একটু যুক্তি, বিজ্ঞান, ভালবাসা এবং অভিজাত্য একটু নজর পেলে সে আবারও ঘুরে দাঁড়াবে। তার মধ্যে আজও প্রবল সম্ভাবনা।
……………………………………………….
আরও পড়ুন শুভঙ্কর দাস-এর লেখা: ফেলুদা, ব্যোমকেশ কলকে পায়নি, কিন্তু বাংলার পুতুল শিল্পে ‘শক্তিমান’ প্রবল জনপ্রিয়
………………………………………………..
অন্যদিকে, জ্ঞানদা চক্রবর্তী পুতুলনাচ সংস্থার কর্ণধার মাধব চক্রবর্তী জানিয়েছেন যে, একটি পুতুলনাচ করতে অন্তত ১০ থেকে ১২ জনের সদস্য লাগে। পুতুলনাচে ব্যবহার করা কাঠের পুতুলগুলোকে ‘ড্যাং পুতুল’ বলা হয়। পুতুলগুলোর কোমরের দিকে বাঁশের কেড়ে থাকে। যে নাচাবে তার কোমরে সেটা বাঁধা থাকে। বছরে মাত্র ৩০ থেকে ৪০টির মতো শো হয়। ফলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই শিল্পকে শেখার কোনও উৎসাহ নেই। যা কি না আগের তুলনায় অনেক কম। সামাজিক, পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ছাড়াও কাল্পনিক গল্পের ওপর ভিত্তি করে পুতুলনাচ হয়। যেমন ‘রক্তমাখা প্রভাত’ একটি কাল্পনিক নাটক।
উল্লেখ্য, বাঙালির স্মৃতিমেদুরতায় পুতুলনাচ রাজ করলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে তা ক্রমাগত বিলুপ্তির পথে। পুতুল নাচনো, গান গাওয়া, যন্ত্রসংগীত বাজানো, যাত্রার বই দেখে নাটকের ভাবনা নিয়ে সেটাকে পুতুলনাচের উপযোগী করে উপস্থাপন করার মধ্যে পরিশ্রম রয়েছে। সেই পরিশ্রমের পথেই হেঁটে চলেছেন সমাজের প্রান্তিক শ্রেণিতে থাকা শিল্পীরা।
…………………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………………….
The post বাংলার পুতুলনাচের শিল্পীরা আজও প্রান্তিক appeared first on Robbar | Sangbad Pratidin.