Quantcast
Viewing all articles
Browse latest Browse all 109

শাসককে দেবতা বানানোর অভিপ্রায়েই কলকাতায় পথে-প্রান্তরে ইংরেজরা বসিয়েছিল মূর্তি

১.

আমাদের দেশে আসার সময় থেকেই ভিনদেশি ইংরেজ মনে করত, এ দেশের কালো জাতিকে বর্বর অবস্থা থেকে মুক্তি দিতেই তার আগমন। ঠিক যেমন মনে করেছিলেন জুলিয়াস সিজার। জুলিয়াসের ভাবনায় ছিল রোমকরা ব্রিটেনের মানুষকে আলো দেখাতে এসেছে। সেই ধারণাকে উপনিবেশের জমিতে প্রয়োগ করেছিল ইংরেজ। পৃথিবীর নগরসভ্যতার প্রধান পথপ্রদর্শক ছিল রোমকরা। আর অন্যদিকে তারা মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী। সেই কারণেই ব্রিটেনের নিজস্ব কেল্ট দেবকূল থাকলেও রোমকরা সেখানে নিজেদের এক অন্য ধারার দেবকূল প্রতিষ্ঠা করেছিল। সেই অন্য ধারার দেবকূলে জুলিয়াস সিজার অকপটে রোমান সম্রাট ও সেনাপতিদের দৈব ক্ষমতার অধিকারী দেখিয়ে নগরের চারপাশে মূর্তি বসানো শুরু করেন। সম্রাট অগাস্টাসের মূর্তি– সেরকম একটি মূর্তি। এই ধারাই রোমকরা অনুসরণ করেন ব্রিটেনের জমিতে। সেই সময় শিল্পকলাকে প্রচার ব্যবস্থার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করাই ছিল দস্তুর। নয়া দেবকূলের জন্য তৈরি হল মূর্তির নতুন আইকোনোগ্রাফি। সেই অনুসারে বয়স্ক বৃদ্ধ সম্রাটদের তরুণ হিসেবে তৈরি করা হত আর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হত দেবতাদের জন্য নির্ধারিত নানা চিহ্ন ও প্রতীক। এই আইকোনোগ্রাফি মাফিক বীর কখনও ‘বৃদ্ধ’ হয় না, বীর চিরনবীন। এইভাবেই রোমে তৈরি হয়েছিল শাসকের দেবকূল বা ‘ডিভাইন স্টেট’। ইংরেজ এদেশে আসার পর যখন কালের নিয়মে কলকাতায় তাদের প্রধান আস্তানা তথা রাজধানী হল, তখন ঠিক এই কাজটিই করেছিল ইংরেজ কলকাতায়। এ দেশে উপনিবেশবাদী দেবকূল প্রতিষ্ঠা করার কাজ শুরু হয়ে গেল। সেই পরিকল্পনা অনুসারেই কলকাতার পথে প্রান্তরে একের পর এক মূর্তি বসাতে থাকে ইংরেজ। নানা প্রতীকে ইংরেজ শাসককে দেবতা বানানো শুরু হয়। তাঁদের চিন্তনে সেদিন ক্যালকাটাই হল ‘ডিভাইন স্টেট’। আর সেই ডিভাইন স্টেটের মূর্তিতে ধরা রইল ইংরেজের ঐশী ক্ষমতার ভাবমূর্তি।

Image may be NSFW.
Clik here to view.

মূর্তি বসবে বেদিতেই, কারণ শাসক হলেন সকলের ঊর্ধ্বে। তাকে দর্শন করতে হয় মাথা ওপরের দিকে তুলে।  ১৮০৩-এ কলকাতায় তৈরি হল লাট প্রাসাদ যা আজকের ‘রাজভবন’। ওই বছরেই কলকাতায় এল লর্ড কর্নওয়ালিসের মূর্তি। ভাবা যায়, তিনি তখনও জীবিত ! আমাদের দেশের ইতিহাস বলছে, ওই বছরেই দ্বিতীয় শাহ আলম পরাজিত হন এবং তাঁর পুত্র দ্বিতীয় আকবরকে ইংরেজরা তাঁদের বিজয় মিছিলে হাঁটতে বাধ্য করেন। কলকাতায় বসল কর্নওয়ালিসের ট্রাইয়াড মূর্তি। মূর্তিটি তৈরি করেছেন পিতা-পুত্র বেকন জন। এই ভাস্কররা কর্নওয়ালিসকে টিউনিক পড়িয়েছিলেন একেবারে রোমান জেনারেলদের মতো। তাঁর পায়ে দিয়েছিলেন রোমান চপ্পল।

Image may be NSFW.
Clik here to view.

মূর্তির ঠিক পিছনের দিক থেকে বাঁদিকে এসেছে একটি শিং মূর্তি। এই গ্রেকো-রোমান মাইথোলজি অনুসারে এই শিং হল প্রাচুর্যের প্রতীক। পোশাকি নাম ‘হর্ন অফ প্লেন্টি’। হর্ন অফ প্লেন্টি সম্পর্কে রোমান মিথে বলা হয়, নদ দেবতা আকেলিউসের চেহারা ছিল ষণ্ডের মতো। সেই ষণ্ডের শিং ভেঙে তাঁকে পরাস্ত করেছিলেন হারকিউলিস। সেই থেকে সেই শিং প্রাচুর্যের শিং হয়ে যায়, আর জাদুবলে তা সারা বছর ফলে-ফুলে-প্রাচুর্যে ভরা থাকে। সেই থেকেই মানুষের মধ্যে হারকিউলিস ‘শ্রেষ্ঠতম বীর’ হিসেবে পরিচিত হলেন। এই রূপক পিতা পুত্র বেকন জন কর্নওয়ালিসের মূর্তি বানানোর সময় তাঁর ওপর আরোপ করলেন। আসলে ধরেই নেওয়া হয়েছিল, কর্নওয়ালিস এদেশে নানা বাধা-বিঘ্ন দূর করে ইংরেজের প্রাচুর্য নিশ্চিত করবেন। আর তিনি তা করেওছিলেন। হারকিউলিসের আরেকটি বীর গাঁথা সূচক সংকেত যুক্ত করা হয় কর্নওয়ালিসের মূর্তিতে। এই সংকেত রয়েছে হারকিউলিসের নিমিয়ান সিংহ বধ করার কাহিনির মধ্যে। এই সিংহ বধ করার পর সিংহের মুণ্ড ও চামড়া ছিল হারকিউলিসের আচ্ছাদন। কর্নওয়ালিসের পায়ের কাছেও যুক্ত করা হয়েছে রাখা সিংহের চামড়া। আসলে মূর্তি নির্মাতারা জানতেন কর্নওয়ালিস সিংহ বিক্রম টিপু সুলতানকে পরাস্ত করেছিলেন। তাঁর হাতের তরোয়াল সরাসরি ক্রুসেডের প্রতীক।

Image may be NSFW.
Clik here to view.

ক্রুসেডের এই প্রতীক দেওয়ার নেপথ্যেও কারণ ছিল। আসলে আমাদের দেশে কর্নওয়ালিস খ্রিস্টধর্মের প্রসারেও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন। কর্নওয়ালিসের মূর্তির পাদদেশে বসে রয়েছেন দুই রমণী। এঁদের মধ্যে একজন রমণীর হাতে সাপ। সাপ হল মিথ অনুসারে ভূমির প্রতীক। আসলে এই সাপ যুক্ত করার মধ্যে দিয়ে আলোকিত করা হল ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তক কর্নওয়ালিসকে। অপর নারী প্রকৃতি দেবী। ইনি বিনয়, সৌন্দর্য ও কোমলতার প্রতীক। এঁর হাতে আয়না। আয়না বিনয়ের প্রতীক। ভাস্কর্যের সঙ্গে লেখা হল– তার চরিত্র গুণ। তাই এই রমণীদের একজন কর্নওয়ালিসের কর্মপন্থাকে চিহ্নিত করে আর অপরজনের মধ্য দিয়ে তার চরিত্রকে আলোকিত করা হল। এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় চরিত্রের ভাবমূর্তি।

Image may be NSFW.
Clik here to view.

এত কিছুর পরেও ইতিহাস অন্য কথা লিখে রাখে। আমেরিকা যখন ব্রিটিশদের থেকে যুদ্ধ করে নিজেদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিচ্ছে তখন এই কর্নওয়ালিসের নেতৃত্বেই ব্রিটিশ সৈন্যেরা আত্মসমর্পণ করে আমেরিকার কাছে। সেই যন্ত্রণা ভুলতেই ভারতের ভূমিতে কালিমালিপ্ত কর্নওয়ালিসের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে দেখাতে চেষ্টা করে ব্রিটিশ, তাই তাকে হারকিউলিস বা ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ বানিয়ে দেওয়া হয়।

ছবি আলোক নূর ইভানা

The post শাসককে দেবতা বানানোর অভিপ্রায়েই কলকাতায় পথে-প্রান্তরে ইংরেজরা বসিয়েছিল মূর্তি appeared first on Robbar | Sangbad Pratidin.


Viewing all articles
Browse latest Browse all 109

Trending Articles