এক ছাত্রী তার গানের মাস্টারমশায়কে বললে, ‘‘আচ্ছা মাস্টারমশায়, আমাকে ‘কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে’ গানটা শিখিয়ে দিন না!” মাস্টারমশায় প্রথমে অবাক, তারপর বুঝলেন, ছাত্রীটি রবীন্দ্রনাথের কোনও গানের কথা বলছে। ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’।
কয়েক বছর আগে এক সিনেমায় ব্যবহৃত হয়ে গানটি জনপ্রিয় হয়েছে। এবং বহুজনে গাইছেন। আর অধিকাংশই শুরু করছেন গানের দ্বিতীয় লাইন (কেন মেঘ আসে) থেকে। এসবের নজির ইউটিউবে ছেয়ে আছে। ইদানীং রবীন্দ্রনাথের গান পরিবেশনে একটা ধরন তৈরি হয়েছে– এই গানের মাঝখান থেকে গান শুরু করার। রবীন্দ্রনাথ তো তাহলে ওই মাঝখান থেকেই আরম্ভ করতে পারতেন ! এমনতর নানা স্বেচ্ছাচারিতা দেখা যাচ্ছে এখনকার রবীন্দ্রসংগীত উপস্থাপনায়। ২০০১-এ স্বত্ব-বিলোপের পর রবীন্দ্রনাথের গান নানাভাবে বিকৃত করা হচ্ছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে। বিকৃতির একটা ধরন, খেয়াল-খুশি মতো সুর-ছন্দ বদলানো। খুব পরিচিত একটি উদাহরণ: ‘বং কনেকশন’ ছবিতে সুপরিচিত ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’ গানটি ৬ মাত্রার দাদরা তালের পরিবর্তে ৮ মাত্রার কাহারবায় গাওয়া হল, এমনকী, শুরুতে কুৎসিতভাবে যোগ করে দেওয়া হল– ‘উলাল্লা’, ‘উলাল্লা’ ভোকাল রিফ্রেন হিসেবে। ‘বেডরুম’ ছবিতে ব্যবহৃত ‘মায়াবনবিহারিণী হরিণী’-র স্থায়ীতে অদ্ভুতভাবে ‘কোমল রে’ লাগিয়ে দেওয়া হল, আভোগে সুরও পরিবর্তিত। গানটি মেজর নোটসের ওপর তৈরি। এক নামী গায়িকা ‘জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে’-এর স্থায়ীতে ‘দাঁড়ায়ে’ জায়গায় তারসপ্তকের ‘স’ থেকে বিসদৃশভাবে নামিয়ে আনেন ‘প’-তে, যা স্বরলিপি-বহির্ভূত।
বিকৃতির আরেক ধরন, গানে অহেতুক রাগালাপ, তানকর্তব করা। এমনতর ইম্প্রোভাইজেশনের কোনও জায়গা রাখেননি রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে। একেবারেই অপছন্দের ছিল এসব রবীন্দ্রনাথের। এই নিয়ে দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতা স্মরণযোগ্য। অথচ একাধিক সুপরিচিত গায়ক-গায়িকা এই পথেই হাঁটছেন। এক উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী ‘ও কেন ভালোবাসা’, ‘কথা কোস নে লো রাই’ সুরবিহার করে গাইলেন। একজন ‘দুই হাতে কালের মন্দিরা’-র শেষে তানকর্তব করলেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
২০০১-এ স্বত্ব-বিলোপের পর রবীন্দ্রনাথের গান নানাভাবে বিকৃত করা হচ্ছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে। বিকৃতির একটা ধরন, খেয়াল-খুশি মতো সুর-ছন্দ বদলানো। খুব পরিচিত একটি উদাহরণ: ‘বং কনেকশন’ ছবিতে সুপরিচিত ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’ গানটি ৬ মাত্রার দাদরা তালের পরিবর্তে ৮ মাত্রার কাহারবায় গাওয়া হল, এমনকী শুরুতে কুৎসিতভাবে যোগ করে দেওয়া হল– ‘উলাল্লা’, ‘উলাল্লা’ ভোকাল রিফ্রেন হিসেবে। ‘বেডরুম’ ছবিতে ব্যবহৃত ‘মায়াবনবিহারিণী হরিণী’-র স্থায়ীতে অদ্ভুতভাবে ‘কোমল রে’ লাগিয়ে দেওয়া হল, আভোগে সুরও পরিবর্তিত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সাম্প্রতিক আরেক উপদ্রব– ফিউশন। রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে দেশি-বিদেশি হরেকরকম গানের কাণ্ডজ্ঞানহীন ফিউশন। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। দুই যুবক, রবীন্দ্রসংগীতে এহেন ফিউশন করে বেশ নাম কামিয়েছেন। তাঁরা ‘চিরসখা ছেড়ো না’ এক সুফি গানের সঙ্গে মিশিয়ে পর্যায়ক্রমে গাইলেন, আর একটু বাদেই এক আশ্চর্য ছন্দে তালবাদ্য বাজতে লাগল– গানটি ধ্বস্ত হল। ওঁদেরই ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’ শুরু হয় সরগম দিয়ে, মাঝে বিসদৃশভাবে আসে ‘বরখাকি রূপ আয়ি ঝুলা ঝুলানে’। ‘মেঘ’ শব্দটি থাকলেও ‘মেঘ বলেছে’ বর্ষার গান নয়। দু’টি গানের মধ্যে কোনও ভাবগত সাদৃশ্য নেই। বসন্ত প্রকৃতির যে উচ্ছল আনন্দ ছেয়ে থাকে ‘মোর বীণা ওঠে’ গানে, তা দিশা হারায় গানের ফাঁকে-ফোকড়ে ভৈরবী ঠুংরির প্রয়োগে। একইভাবে ‘আলোয় আলোকময় করে’ বা ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’ প্রার্থিত গভীরতা হারায় ফিউশনের অনুপ্রবেশে।
এই যে, সুর-তাল বদলানো, তানকর্তব-সুরবিহার, ফিউশন– এসবেরই কারণ কিছু একটা অন্যরকম করে সাধারণ লোকের কাছে সহজে পৌঁছনো। স্বরলিপি-টরলিপি মেনে ঠিকঠাক গেয়ে মানুষের কাছে পৌঁছনো যাচ্ছে না, উপার্জন করা যাচ্ছে না– এমনই একটা ধারণা হয়েছে অনেকের, সুতরাং…। আর এসব করে বুঝেও যাচ্ছেন যে তাঁদের উদ্দেশ্য সফল, তার দুর্মর চিহ্ন ইউটিউবে লাখো-ভিউজ আর হাজারো লাইকে। যাঁরা রবীন্দ্রনাথের গানের পরিবেশনে নানা ধরনের বিকৃতি ঘটাচ্ছেন তাঁরা রবীন্দ্রসংগীত বা অন্যান্য গান থেকে উপাদান নিয়ে নিজেদের মর্জিমাফিক মৌলিক গান তৈরি করুন না! কিন্তু তার জন্যে চাই বিপুল ক্ষমতা আর সংগীতবোধ। এবং তা সময়সাপেক্ষও বটে। তার চেয়ে হাতের কাছে রবীন্দ্রনাথের গানের মতো এমন চমৎকার কম্পোজিশন রয়েছে, তাকে একটু অদলবদল করে, গলার কায়দা দেখিয়ে সুরবিহার করে বা মাঝে অন্য গান ঢুকিয়ে পরিবেশন করে সহজেই অনেক লোকের কাছে পৌঁছনো যাচ্ছে, নাম-পয়সা হচ্ছে। বেশিরভাগ শ্রোতাই তৈরি নন, ফলে যা খুশি তাই করা যাচ্ছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: চানঘরে রবীন্দ্রসংগীত গাইলেও আপত্তি ছিল না রবীন্দ্রনাথের
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রবীন্দ্রসংগীতের মতো সৃষ্টি উপভোগ করতে হলে শ্রোতাদেরও একটু তৈরি হওয়া দরকার বইকি। সবচেয়ে দুঃখজনক, যাঁরা রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে রয়েছেন, জীবিকা নির্বাহ করছেন তাই দিয়ে, তাঁদের অনেকেরই রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে ধ্যানধারণা খুবই সীমিত। গান শেখার ক্ষেত্রেও নিষ্ঠার অভাব প্রকট। লক্ষ্য কেবল যেনতেন প্রকারেণ মঞ্চে বা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে গান গাওয়া। গুণ নয়, পয়সা-প্রতিপত্তির জোরে অনেকেই সুযোগ পাচ্ছেন। ক’জন রবীন্দ্রসংগীত গায়ক বা শিক্ষক রবীন্দ্রনাথের ‘সংগীত চিন্তা’ গ্রন্থটি পড়েছেন? গান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সমূহ লেখালেখি, চিঠিপত্র, আলাপচারিতা নিয়ে ‘সংগীত চিন্তা’ প্রকাশ করেছিল বিশ্বভারতী, পুলিনবিহারী সেনের সম্পাদনায় ১৯৬৬-তে।
রবীন্দ্রনাথের গানে বিকৃতি, স্বাধীনতা নেওয়া রবীন্দ্রনাথের সময়েও ছিল। ১৯৪০-এ ‘গীতালি’ সংগীত শিক্ষায়তনের উদ্বোধনী ভাষণে রবীন্দ্রনাথ এই বলে দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন, ‘…আমার গান শুনে নিজের গান কিনা বুঝতে পারি না। নিজে রচনা করলুম, পরের মুখে নষ্ট হচ্ছে, এ যেন অসহ্য।’ এর আগেই ১৯৩৮-এ জানকীনাথ বসুকে লেখা এক চিঠিতে বলেছিলেন, ‘আজকালকার অনেক রেডিওগায়কও অহংকার করে বলে থাকেন তাঁরা আমার গানের উন্নতিসাধন করে থাকেন। মনে মনে বলি পরের গানের উন্নতি-সাধনে প্রতিভার অপব্যয় না করে নিজের গানের রচনায় মন দিলে তাঁরা ধন্য হতে পারেন।’
আজ, এই সময়েও রবীন্দ্রনাথের একথা কী দারুণভাবেই না প্রাসঙ্গিক!
The post ইউটিউব কি রবীন্দ্রনাথের গান বদলে দেবে নাকি! appeared first on Robbar | Sangbad Pratidin.