Quantcast
Channel: পাঁচমিশালি Archives - Robbar | Sangbad Pratidin
Viewing all articles
Browse latest Browse all 112

আমি নিশ্চিত আমার ভাগ্যরেখায় ব্ল্যাকারসঙ্গ লেখা ছিল

$
0
0

আঙ্গা। আমার ইশকুলের বন্ধু। হাইস্কুলের। আঙ্গার ভালো নাম সম্ভবত আশীষ বসু। সম্ভবত এই জন্য সে তার বহুবিধ কীর্তিকলাপের সঙ্গে সঙ্গে তার ডাকনামটিও স্মৃতির পোকায় কেটেছে। যেটুকু অবশিষ্ট আছে তা হল, আঙ্গা রবীন্দ্রনাথকে বলত ‘আর. নাথ’, স্বপনকুমারকে বলত ‘এস. কুমার’, আমাদের প্রধান শিক্ষক দীনেশ মজুমদারকে ডাকত ‘ডি.এম’, নজরুল ইসলামকে ‘এন.ই’। আঙ্গাই প্রথমে আমাদের ক্লাস চলার সময় কীভাবে পাঠ্যবইয়ের মাঝখানে এস.কুমার রেখে পড়তে হয় শিখিয়েছিল। এসবের পাশাপাশি শিখিয়েছিল–

১. কীভাবে দম বন্ধ করে জল খেয়ে পেট ফুলিয়ে কিংবা টাইট বেল্ট পরে চার/দশ ফুটবলের প্রাথমিক পর্যায়ে কোয়ালিফাই হতে হয়।

২. কীভাবে স্কুলের জানালা গলে পালিয়ে যেতে হয়।

৩. কীভাবে ব্ল্যাকারদের সঙ্গে দরদাম করতে হয়।

আমাদের হাতের কাছে ছিল রূপমন্দির সিনেমাহল আর বিভা সিনেমাহল। রূপমন্দির এখনও আছে আর বিভা চলে গিয়েছে প্রোমোটারের গ্রাসে। রূপমন্দিরই ছিল ব্ল্যাক-শিক্ষার প্রথম বিদ্যালয়। রূপমন্দির ছোট সিনেমাহল। তাই ভালো ফিল্ম এলে অবধারিত টিকিট ব্ল্যাক হত। রতন, বুলাই, বিক্রমরা মহাবিক্রমে টিকিট বিক্রি করত। মনে মনে ভাবত যে, তারা এক একজন গুপ্তসমিতির মেম্বার। যেকোনও সময় গ্রেপ্তার হতে পারে। যদিও কখনও ব্ল্যাক করার জন্য গ্রেপ্তার হয়নি। যে দু’-একবার গ্রেপ্তার হত তা নিজেদের মধ্যে মারামারির জন্য। শালা, ক্ষুর চালিয়ে দেব, এই ছিল তাদের সর্বোচ্চ হুমকি। যাই হোক আমরা যেতাম, বিক্রমদের খুঁজে বের করতাম। অধিকতর নিচু গলায় বলতাম, ‘আছে’? না থাকলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল। আর থাকলে বলতো, ‘পাশে চলে যাও, ওখানে বুলাই আছে’। আমরা রূপমন্দিরের পাশে গিয়ে বুলাইকে বলতাম যে বিক্রম পাঠিয়েছে।

–কটা চাই?

–কত করে?

–কোন ক্লাস?

–৬৫ পয়সার।

–দেড় টাকা।

–আমাদের পাঁচটা লাগবে।

–এক পঁচিশ।

–তাহলে আর হল না!

আমরা চলে যাওয়ার ভান করতেই বুলাই বলত,

–স্টুডেন্ট?

–হুম।

–তাহলে এক, স্টুডেন্ট কনসেশন।

–৮০ আছে

–দে দে, তাড়াতাড়ি বের কর।

আমরা গুনে গুনে চার টাকা দিলে ও প্যান্টের ভিতরের পকেট থেকে একগোছা টিকিট বের করে, অতি গোপনভাবে পাঁচটি টিকিট দিয়ে আমাদের বিদায় করত। আমাদের পিছনে তখন ভিড় জমে গিয়েছে।

অলংকরণ: প্রণবেশ মাইতি

এই লাইনে যে আঙ্গার হাতযশ দিনে দিনে বাড়ছে, তা ভালো সিনেমা এলেই ওর উত্তেজনায় আমরা টের পেতাম। কখনও কখনও ক্লাসেই হয়তো বা ফিসফিস করে বলত।

–যাবি?

–কোথায়?

–ধনরাজ তামাং, সুপার হিট!

–টিকিট?

–সে তো আমি দেব

–তুই?

এবার আর কথা নয়। কে. সি. নাগের ভিতর থেকে খান দশেক টিকিট বের করল–

–এই দেখ,

–এতগুলো?

–মাত্র দশটা। আটটাই বিক্রি হয়ে গেছে, হাইরেট। দুটো মাত্র রেখেছি তোর আমার জন্য।

প্ররোচনা, প্ররোচনা, প্ররোচনা! স্কুল কাটলাম। সিনেমা হলে গিয়ে আমার হাতে আটটা টিকিট দিয়ে বলল, হলের পিছনে চলে যা, কেউ এসে আমার নাম করলে কথা না বলে যেক’টা চাইবে দিয়ে দিবি; এক একটা টিকিটের দাম তিন টাকা, বুঝে নিবি।

এইভাবে ক্রমে ক্রমে আমিও বুলাই হয়ে উঠছিলাম। কিন্তু বাধ সাধলেন আমার বাবার এক বন্ধু। তিনি একদিন ফিল্ম দেখতে এসে আঙ্গার খপ্পরে পরলেন। সুতরাং, আমার কাছে এলেন, সুতরাং বাবার কাছে গেলেন, সুতরাং উত্তম-মধ্যম। আমার আর বুলাই হয়ে ওঠা হল না।

তবে আমি নিশ্চিত আমার ভাগ্যরেখায় ব্ল্যাকারসঙ্গ লেখা ছিল। আমার লেখা ময়দান ও পানশালা যারা পড়েছেন তারা তো জানেনই। যারা জানেন না তাদের সংক্ষেপে জানাই। ময়দানে একটা সময় আমাদের জমজমাট আড্ডা ছিল। মজলিশ! বিকেলের মজলিশ!

তো, অন্ধকার ঘন হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেই আড্ডায় এসে জড়ো হতেন নানা কিসিমের মানুষ। তাদের প্রায় সবাই এই ময়দানেই বিভিন্ন পেশায় যুক্ত। কারও খচ্চরের ব্যবসা, কেউ চালান ঘোড়ার গাড়ি, কেউ কেউ বিক্রি করেন চা-চানাচুর, কেউ কেউ শরীর, কারও কারবার হাতসাফাই, কেউ-বা বিক্রি করেন জল। কেউ-বা দিতেন ফুটবল বা ক্রিকেটের তালিম। আবার কেউ কেউ ময়দানে হাঁটতে আসেন। একজন ছিলেন রামহরি মাল। তার ছিল কথকতার কারবার।

এ-রকমই একদিনের মজলিশে হঠাৎ বুকপকেট থেকে একটি কাগজ বের করে খিদিরপুরের রমেন বলল যে, সে একটি কবিতা লিখেছে, শোনাতে চায়। সবাই শুনতে সম্মত, রমেন কাঁপা কাঁপা গলায়, ‘আমিও ঘুমোতে চাই তোমার কোলে/খোলা আকাশের নীচে/আমার মাথার চুলে তোমার আঙুলেরা ঘোরে/যেন রাজহাঁস।’

অমিতাভদা, কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত চিৎকার করে উঠলেন, ‘শাবাশ!’

রমেন, রমেন দাস। খিদিরপুর এলাকায় সিনেমার টিকিট ব্ল‍্যাক করত। ময়দানে চা-ব্যবসায়ী অসীমের বন্ধু। অসীমের সঙ্গেই কখনও কখনও আসত। রফির গান গাইত। গালে কাটা দাগ। আড্ডায় গান শুরু হলে নিয়মিত আড্ডাধারী বাদ দিয়েও কিছু অনিয়মিত শ্রোতা এসে আড্ডার চারপাশে জুটতেন। আর এরা জুটলেই সন্ধ্যা, অনিমারাও ঘুরঘুর করত। বাবু লাভের আশায়। তাদের জুটেও যেত প্রায় প্রত্যেকদিনই। আমাদের রমেনবাবুর একদিন চোখ গেল সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যার সঙ্গে মিলিয়েও গেল কোথায়। তারপর মাসখানেক সন্ধ্যাকেও দেখি না। রমেনকেও না। সুলেমান একদিন খবর দিল যে, ওদের দু’জনকে নাকি ভিক্টোরিয়ায় দেখা গেছে। অতঃপর এল সেই দিন। ২৫ বৈশাখ। ময়দানে রবির আড্ডা। সভাপতি অমিতাভ দাশগুপ্ত। প্রধান অতিথি আয়ান রশীদ খান। আসর সবে জমে উঠেছে। ঠিক তেমন সময় ময়দানের সামনে এসে দাঁড়াল একটা হলুদ ট্যাক্সি। ট্যাক্সির সামনে একটা বড় ফুলের প্রজাপতি, আমাদের প্রত্যেককে হতবাক করে দিয়ে সেই ট্যাক্সি থেকে নেমে এলেন নববিবাহিত সন্ধ্যা ও রমেন। মাথায় টোপর, গলায় মালা। রমেনের হাতে ইয়া বড় এক মিষ্টির বাক্স। আমাদের রবি-আড্ডা বদলে গেল বিবাহবাসরে। অমিতাভদা, বিষ্ণু গান গাইলেন বিয়ের গান। রশীদদা নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করলেন। নিজের হাতঘড়ি খুলে পরিয়ে দিলেন রমেনকে। লাজুক নবদম্পতি একে একে প্রায় সবাইকে প্রণাম করল। সুলেমানের নাকে-মুখে সানাই বেজে উঠল। মিষ্টিমুখের পর অমিতাভদা বললেন, ‘এত অল্পতেই কী হয়? পার্টি চাই।’ পার্টি হল। রশীদদার নেতৃত্বে পুলিশক্লাবে আমাদের জনা পনেরোর পার্টি। ওই রাতেই রশীদদা রমেনের জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থাও করলেন। কলকাতার বাইরে একটা গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকার। এর দু’-দিন পরেই রমেন-সন্ধ্যা চলল কর্মস্থলে। ওরা এখনও ওখানেই। ওদের একটি পুত্র। দশম শ্রেণিতে পড়ে। নাম রেখেছে আয়ান।

‘টাইগার’ সিনেমাহলের সামনে অনুপকুমার এবং বিকাশ রায়। ‘জীবন কাহিনী’ ছবির স্থিরচিত্র

কত খেলা যে এ দুনিয়ার! দুনিয়া খেলাও তুমি, দুনিয়া খেলায়! আর ছিল টাইগার। টাইগার সিনেমাহল। ছিল, এখন নেই। এই টাইগার সিনেমাহলে ছিল এক টাইগার। সত্যি সত্যি টাইগার নয়। শিবু। ব্ল্যাকার হিসেবে ওর প্রতিপত্তি প্রায় বাঘের মতোই। তাই আমি ওকে ডাকতাম টাইগার। এই টাইগার আমাকে প্রথম ফিল্ম দেখতে নিয়ে যায়। বন্ধু বিশ্বজিৎ, বিশ্বজিৎ পণ্ডা। তারপর আমি প্রায়ই যেতাম একা একাই। দু’-চারবার প্রবীর ভৌমিকের সঙ্গে। প্রবীরদা প্রায়ই যেতে চাইত। কেন-না ওখানে একটা ছোট বার ছিল। টাইগারের বৈশিষ্ট্য ছিল, খুব তাড়াতাড়ি হাউসফুল হয়ে যেত। ব্ল্যাকারদের হাতে টিকিট। পঁচিশ/পঞ্চাশ, পঞ্চাশ/একশো এই জাতীয় মধুরধ্বনি টাইগারের চাতাল আচ্ছন্ন করে রাখত। এখানেই টাইগারের সঙ্গে আমার পরিচয়। টাইগারে ভরসা রেখে আমার টিকিট কেনা। প্রথম প্রথম চড়া দামে, পরে ঠিকঠাক দামে। কেন ঠিকঠাক দামে? আমাদের দেখে ওর মনে হয়েছিল যে আমাদের বেশি টাকা দিয়ে সিনেমা দেখার মুরোদ নেই। একথা ফিসফিস করে জানিয়েছিল একদিন পানের আসরে। টাইগার গেল, সঙ্গে সঙ্গে টাইগার শিবুও হাওয়া হয়ে গেল। এর প্রায় বছর তিনেক পরে টাইগার শিবু ফুটে উঠল এক দিশি পানশালায়। এ. জে. সি বোস রোডে, বিশ্বভারতীর একটু আগে একটি দোতলা দিশি পানশালায়। এই ঠিকানা আমাকে চিনিয়েছিল মৌতাত মহেশ্বর শ্রীযুক্ত দীপ মুখোপাধ্যায়। এক বর্ষার বিকেলে ছত্রহীন আমি নিরুপায় ঠাঁই খুঁজি ওইখানে। একতলা ঠাসা, কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাই দোতলায়, ঠাসা। ফিরে আসছি এমন সময় শুনি কে যেন ডাকে আমারে!

–ও দাড়িদা, ও দাড়িদা

তাকিয়ে দেখি টাইগার! একটি বেঞ্চের এক কোণে বুকের বোতাম খুলে বসে। ঠোঁটে বিটকেল হাসি।

–আরে টাইগার, তুমি!

সে আমাকে চুপ থাকতে বলে কাছে ডাকে।

–আসুন দাদা, একটু চেপে বসলেই হয়ে যাবে। তেঁতুল পাতায় ছ’জন। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ আর আপনি ছয়। বসুন। বসলে বলে, এইখানে কেউ আর টাইগার বলে না। দু’একজন বন্ধুবান্ধব বলে কাটা শিবে।

–কাটা শিবে!

–হুম, এখন কাটা কাপড়ের বিজনেস করি কি না!

সেবার অনেক রাত অবধি শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আমাদের তুমুল হই হই। জীবনে খুব কমই হয়।

রাতে ফেরার ট্যাক্সি ধরতে যাব। শিবু আমার হাত চেপে ধরল। বৃষ্টির জলে ওর চোখের জল বুঝতে পারলাম না। গলায় কান্না।

–দাদা আমার কাছে ব্যাগে কাগজ পেন আছে। চলুন ওই শেডের নিচে দাঁড়িয়ে আপনার বার্থডে আর মোবাইল নম্বর লিখে দিন। দিলাম।

–শিবু, তোমার জন্মদিন কবে?

–না, দাদা আমার কোনও জন্মদিন নেই। বৃষ্টির কি কোনও জন্মদিন হয়?

বলে এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে গাঁজা পার্কের পাশের রাস্তা দিয়ে দৌড় দিল। এমন দৌড় যেন কেউ তাকে তাড়া করেছে। ধরা যাক বৃষ্টিই।

The post আমি নিশ্চিত আমার ভাগ্যরেখায় ব্ল্যাকারসঙ্গ লেখা ছিল appeared first on Robbar | Sangbad Pratidin.


Viewing all articles
Browse latest Browse all 112

Trending Articles