Quantcast
Channel: পাঁচমিশালি Archives - Robbar | Sangbad Pratidin
Viewing all articles
Browse latest Browse all 115

যে পুণ্যলাভের জন্য নিরীহ পশুর প্রাণ যায়, তা অমানবিক

$
0
0

ছোটবেলায় শুনেছি, ভারত মুনি-ঋষিদের দেশ। বাংলা থেকে পাঞ্জাব বলুন কিংবা কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা– সর্বত্র নানা ধর্মের, নানা বর্ণের মানুষের বসবাস। আর সেই বৈচিত্রে সুন্দর আমার দেশ। ভারতের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা তীর্থক্ষেত্র। আর সেই তীর্থের উদ্দেশে যাত্রাকে ঘিরে মানুষের উৎসাহ, উদ্দীপনা চিরকালের। আমার উপলব্ধির জায়গা থেকে বলতে পারি, মানুষ তীর্থক্ষেত্রে যায় পুণ্য লাভের আশায়। তীর্থ অর্থাৎ সেই পবিত্রস্থান, যেখানে পায়ে হেঁটে যেতে হয়। মোক্ষলাভের স্বপ্নে পথের ক্লান্তিকে বরণ করে নেয় মানুষ। উপেক্ষা করে যাবতীয় যন্ত্রণা, শোক-তাপকে। এসব নিজের চোখে দেখা। আসলে তীর্থযাত্রায় যতই কষ্টসাধ্য পরিশ্রম হোক না কেন, পুণ্যলাভের আশায় মানুষ তা মন থেকে মেনে নেয়। পথ দুর্গম হলেও মনকে শক্ত করে সেই পথে পাড়ি জমায়। এসবের নেপথ্যে কাজ করে মানুষের পুণ্যলাভের আশা। তীর্থক্ষেত্রে তো আর কেউ পাপ অর্জনের জন্য যান না। কিন্তু সত্যি কি পুণ্য লাভ ঘটে? আমরা যারা নিজেদের তীর্থযাত্রী কিংবা পুণ্যার্থী বলে দাবি করি, আমরা নিজেদের অজান্তেই কি পুণ্যের বদলে পাপকে বরণ করে নিচ্ছি না?

অমরনাথ দর্শনে পুণ্যার্থীরা

ভাবছেন, কেন বলছি এমন কথা? বলার যথেষ্ট কারণ আছে।

শৈবতীর্থ হিসেবে অমরনাথ-ধাম যথেষ্ট পরিচিত। প্রতি বছর লক্ষাধিক মানুষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগকে উপেক্ষা করে, শারীরিক কষ্ট সহ্য করে, দুর্গম পথ পেরিয়ে অমরনাথ-যাত্রা করে থাকেন। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই তীর্থযাত্রা সম্ভব হয়। ফলে সাধারণের মধ্যে একটা আলাদা উৎসাহ কাজ করে অমরনাথ-দর্শনকে ঘিরে। প্রায় ৩৫-৪০ দিনের জন্য খোলা থাকে অমরনাথ যাত্রার পথ। আর এই ৩৫-৪০ দিনে প্রতিদিন কমবেশি ৩০,০০০ পুণ্যার্থী শামিল হন এই যাত্রাপথে। যার মধ্যে মাত্র ৭ শতাংশ পায়ে হেঁটে পৌঁছোয় অমরনাথ গুহায়। আর বাকি ৯৩ শতাংশের দশ ভাগ হেলিকপ্টারে সওয়ার হয়ে অমরনাথ দর্শন সাঙ্গ করে। ব্যয়বহুল হলেও সেই পরিষেবা যাত্রীসাধারণের জন্য অনেক বেশি আরামদায়ক। বাকি ৮৩ শতাংশ মানুষ, তারা কীভাবে যাত্রা করেন অমরনাথের উদ্দেশে? ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হওয়া ছাড়া তাদের অন্য কোনও উপায় নেই ওই দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার। অর্থাৎ, যাত্রীপিছু একটি করে ঘোড়া মজুত থাকে।

পুণ্য অর্জনে ভরসা যখন ঘোড়া

সবচেয়ে নিষ্ঠুর ব্যাপার হল, যে ঘোড়াগুলোকে বাছাই করা হয়, এই যাত্রাপথে তাদের কোনও খাবার দেওয়া হয় না। এমনকী, একবিন্দু জলও না। কেন? কারণ, ওই উচ্চতায় খাবার খাওয়ার পর ঘোড়া উদ্যম হারিয়ে শ্রান্ত হয়ে পড়বে, শরীর ছেড়ে দেবে, ফলে তার অবসন্ন শরীর চলার সক্ষমতা হারাবে। ঘোড়া তখন আর হাঁটবে না, দৌড়বে না, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিতে চাইবে। এদিকে ঘোড়ার মালিক যারা, তাদের লক্ষ্য থাকে, দিনে এক কিংবা দুটো ট্রিপ করার। ফলে ঘোড়াটার ওপর পাশবিক অত্যাচার করা হয়। এবং সেই নির্মম অত্যাচারে ঘোড়া মাঝরাস্তায় মারাও যায়। সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্য চোখের সামনে দেখা সত্যি কষ্টকর।

মৃত ঘোড়া

রাস্তায় পড়ে থাকা ঘোড়ার নিথর দেহের পাশ দিয়ে অন্য ঘোড়াগুলো এগিয়ে চলে। তাদের সেই যাত্রা পিঠে বসে থাকা পুণ্যার্থীকে তাঁর মোক্ষলাভের দরজায় পৌঁছে দিতে, নাকি নিজের মৃত্যুর দিকে– তা বোঝার উপায় নেই। মৃত্যুর পরের ঘটনা আরও ভয়ংকর। ওই সদ্যমৃত ঘোড়ার দেহ সৎকারের কোনও চেষ্টাও করা হয় না। সহজ উপায় হাতের কাছেই রয়েছে। নিথর দেহটাকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয় পাশের খাদে, গড়িয়ে পড়ে যায় তা কয়েকশো ফুট নিচে। স্রেফ একটা বাতিল সংখ্যা হিসেবে। নির্মম প্রথার মতোই দিনের পর দিন এই কাজ চলছে। ৩৫-৪০ দিন অমরনাথ খোলা থাকে। দিনে প্রায় চার-পাঁচটা ঘোড়া এভাবেই মারা যায়। ফলে গোটা সময় পর্ব ধরলে প্রায় কয়েকশো ঘোড়া মারা যায়। এই নিয়ে কিন্তু কারও মধ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখি না।

…………………………………………………………..

প্রায় ৩৫-৪০ দিনের জন্য খোলা থাকে অমরনাথ যাত্রার পথ। আর এই ৩৫-৪০ দিনে প্রতিদিন কমবেশি ৩০,০০০ পুণ্যার্থী শামিল হন এই যাত্রাপথে। যার মধ্যে মাত্র ৭ শতাংশ পায়ে হেঁটে পৌঁছোয় অমরনাথ গুহায়। আর বাকি ৯৩ শতাংশের দশ ভাগ হেলিকপ্টারে সওয়ার হয়ে অমরনাথ দর্শন সাঙ্গ করে। ব্যয়বহুল হলেও সেই পরিষেবা যাত্রীসাধারণের জন্য অনেক বেশি আরামদায়ক। বাকি ৮৩ শতাংশ মানুষ, তারা কীভাবে যাত্রা করেন অমরনাথের উদ্দেশে? ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হওয়া ছাড়া তাদের অন্য কোনও উপায় নেই ওই দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার।

…………………………………………………………..

কাশ্মীর অর্থাৎ ভূস্বর্গ। তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কোনও তুলনা নেই। সেই সুন্দরের পাশে কত ভয়ংকর এই জীবন-মৃত্যুর খেলা। কাশ্মীরের যে সৌন্দর্যের কথা বলি, তার বেশিরভাগটাই আছে এই অমরনাথ যাত্রায়। পায়ে হেঁটে যে পুণ্যার্থী এগিয়ে চলেছেন, তার যাবতীয় ক্লান্তি, অবসাদ মুছে যাবে পথপ্রান্তে এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে। অনেক উঁচুতে হওয়ায় অক্সিজেনের লেভেল অনেক কম। ফলে অধিকাংশ পুণ্যার্থীদের শ্বাসকষ্ট-সহ, অধিক উচ্চতায় নানা সমস্যা হয়। পুরোটাই খাড়াই পথ। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ে ঘোড়াও অবাধ্য হয়ে ওঠে। খাড়াই পথে তাদের পা পিছলে যায়, অসতর্কতায় চলে যায় খাদের কিনারে। আবার অনেক সময় অবাধ্য ঘোড়া পথচলতি অন্যান্য পুণ্যার্থীর ধাক্কা মেরে চলে যাচ্ছে, এমন ঘটনাও ঘটে। তখন ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পায়ে লোহার রড দিয়ে মারা হয়, সেই যন্ত্রণায় চোখমুখ ঠিকরে বের আসে ঘোড়ার, প্রবল আর্তনাদ করে। এই অমানবিকতা মেনে নেওয়া কঠিন। প্রশ্ন ওঠে নিজেদের বিবেকবোধ নিয়েই।

মৃত ঘোড়াকে খাদে ফেলতে তৎপর কর্মীরা

আরও একটা ব্যাপার অমরনাথ যাত্রায় চোখে পড়ে। তীর্থক্ষেত্রে গিয়েছি নাকি যুদ্ধক্ষেত্রে, তা বোঝা দুষ্কর। অমরনাথ যাত্রাকে কেন যুদ্ধক্ষেত্র বললাম? গোটা অঞ্চলটাই সীমান্তপ্রদেশীয় হওয়ায় নাশকতার সম্ভাবনা থাকে। ফলে তীর্থক্ষেত্রে পুণ্যার্থীদের ওপর সবসময় নজরদারি থাকে ভারতীয় সেনার। ৩০ ফুট দূরে দূরে এক একজন সিআরপিএফ জওয়ান, আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে। এত নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা, অতন্ত্র পাহারা আমি আগে কোথাও দেখিনি। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে স্নাইপার বসে। অদ্ভুত সব ট্যাঙ্কার নিয়ে ভারতীয় সেনা এলাকা টহল দিচ্ছে লাগাতার। মাছি গলার সুযোগ নেই।

নিরাপত্তার চাদরে মোড়া অমরনাথ যাত্রা

তাছাড়া সরকারের তরফে পুণ্যার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট দিনক্ষণ বেঁধে দেওয়া যে, এই তারিখের মধ্যেই যাত্রা করতে হবে। সবাই গলায় একটা আরএফআইডি কার্ড ঝুলিয়ে যায়। সেটা কি? দেশ এখন প্রযুক্তিগত দিক থেকে অনেক উন্নত। অতীতে অমরনাথ যাত্রায় নানা নাশকতামূলক হামলার ঘটনা আমরা ঘটতে দেখেছি। তাতে দেশের নিরাপত্তার পাশাপাশি পুণ্যার্থীদের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। সেসব মাথায় রেখেই সেই কার্ডের মধ্যে একটা ম্যাগনেটিং চিপ থাকে, যার মাধ্যমে পুণ্যার্থীর এই বিপদসংকুল ও কষ্টসাধ্য পথপরিক্রমার গতিপথ ট্র্যাক করতে সুবিধা হয়। ফলে কেউ দুর্ঘটনার কবলে পড়লে কিংবা খাদে পড়ে গেলে, বা কোনও অসুবিধায় পড়লে তাঁদের ট্র্যাকিং সিস্টেমের মাধ্যমে খোঁজ করতে সুবিধা হয় সরকার। আগে কী হত, অমরনাথ যাত্রায় প্রচুর কিডন্যাপিং, মিসিং কেস হত, যার কুলকিনারা হত না, সেই নাশকতামূলক ঘটনার নিয়ন্ত্রণে এখন এইরকম নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা তৈরি করা হয়েছে।

দুর্গম পথ ধরেই মোক্ষলাভের আশায় পাড়ি পুণ্যার্থীদের

………………………………………………………….

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

………………………………………………………….

অমরনাথ যাত্রার যে পথ, সেটা প্রচণ্ড খাড়াই। বিপদসঙ্কুল রাস্তা। একটু এদিক-ওদিক মানে সটান খাদে। আর গোটা রাস্তা চুনাপাথরে ভর্তি। তাই স্লাইডিংয়ে চান্সও খুব বেশি। সেনা কর্তৃপক্ষ যদিও একদিকে লোহার রেলিং দিয়েছে বটে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। স্লাইডিংয়ের কারণে দিন-দুয়েক অমরনাথ যাত্রা বন্ধও ছিল। আমাদের সামনেই তো স্লাইডিং হয়েছে একবার। চন্দনওয়ারি, শেষনাগ এবং পঞ্চতরণীতে পুণ্যার্থীদের ক্যাম্প রয়েছে। পঞ্চতরণী থেকে অমরনাথ ৬ কিমি। ওটাই শেষ পয়েন্ট। ফলে নিয়ম হচ্ছে, পঞ্চতরণীতে পৌঁছে ওইদিনই অমরনাথ দর্শন করতে হবে, এবং ওই দিনই নিচে নেমে আসতে হবে। ক্লান্তি আসুক, যাই হয়ে যাক, থাকার উপায় নেই। প্রতি ১৬ কিমি ব্যবধানে ক্যাম্প। অর্থাৎ, প্রতিদিন প্রায় ৩০,০০০ লোক এক একটা ক্যাম্পে থাকছে। আবার নেমে আসছে। চাইলেও একের বেশি দিন ওখানে থাকার উপায় নেই কোনও পুণ্যার্থীর। তবে পরিস্থিতি যাই হোক, পথ যতই হোক বিপদসঙ্কুল, অমরনাথ যাত্রায় হেঁটে ওঠাই ভালো, নতুবা হেলিকপ্টার। পুণ্য অর্জনের অছিলায় কিছু নিরীহ জীবের প্রাণের আহুতি দেওয়া মোটেই সঠিক উপায় হতে পারে না।

ছবিস্বত্ব: শুভ্ররূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

 

…………………………………………… আরও পড়ুন নীলকণ্ঠ-এর অন্যান্য লেখা ……………………………………….

পার্থ দাশগুপ্ত-র লেখা: শিবের পোর্ট্রেটই পেরেছে ‘বিয়িং হিউম্যান’ লেখা টি-শার্টকে টেক্কা দিতে

শুভঙ্কর দাস-এর লেখা: কোলে গণেশ, তাই বঙ্গীয় লোকজ শিল্পের শিব গলায় সাপ রাখেননি

সুপ্রতিম কর্মকার-এর লেখা: নদী-পুকুর-জলাশয়ের পাশেই কেন থাকে শিবের মন্দির কিংবা থান?

The post যে পুণ্যলাভের জন্য নিরীহ পশুর প্রাণ যায়, তা অমানবিক appeared first on Robbar | Sangbad Pratidin.


Viewing all articles
Browse latest Browse all 115

Trending Articles