Quantcast
Channel: পাঁচমিশালি Archives - Robbar | Sangbad Pratidin
Viewing all articles
Browse latest Browse all 110

বাংলার প্রাচীন শ্মশানবন্ধুদের বিয়োগব্যথার গান

$
0
0
‘…হরিবোল মন-রসনা, আরকি মানবজনম হবে/ একবার বোল হরিবোল…’
কিংবা
‘… ফুরিয়ে গেলে দেহের সময়, মন তো থাকবে না/ দিনের পরে দিন পেরিয়ে, হিসেব থামবে না।/ মনের স্বজন চলে গেলে, আর তো ফিরবে না…’
আলো পড়ে এসেছে জীবনের পরিধিতে। আর সেই অনুভবেই দুরুদুরু বুক কাঁপা শুরু। ছায়াবৃত্তের খেলায় গা-বাজা শুরু, আর ভিতরে ভিতরে, অন্তিমের সেই ডাক! রামকৃষ্ণের সেই ফুঁপি ধরানো কথা, ‘দিন যায়, কথা থাকে।/ ধর্মের ঢাক, আপনি বাজে।’ মৃত্যু শব্দটির সঙ্গে একটি বিষাদের আবহ শুরু হয়, রক্তের শরীরে। ভয় কি কাজ করে তখন? কেমন করে ভয়ের জন্ম হয়? মনের দেওয়াল নড়ে ওঠে কখনও কখনও ভয়কে আশ্রয় করেই। অনেকেই এড়িয়ে চলতে চাই। তবে পারে কি? কিন্তু শাশ্বত এই সত্য আমাদের আজন্মের একমাত্র সঙ্গী। প্রতিদিনই বেঁচে থাকা যেন, একদিন মরার অপেক্ষায় থাকা। এবার মৃত্যুর পর উদ্দেশ্যহীন ঠিকানায় আপনি চলে গেলেন, কোনও এক অজানায়। আপনার মৃত্যু হয়েছে ধরে নিতেই পারেন, যেমনটা সাধকরা ভাবেন। এরপর কী! কিছু আছে কি সত্যিই মরণের পর?
কল্পনার এক শক্তিশালী জায়গা রয়েছে জীবনকে নির্ভর করেই। আধ্যাত্মিকরা বলেন, আপনার দেহের মৃত্যু হয়েছে, আত্মার নয়। আত্মা আসলে দেহেরই আত্মীয়। গীতাতেও তেমনই জন্মান্তরের কথা বলা হয়েছে। রূপান্তরের কথা বলা হয়েছে বিজ্ঞানে। জিন তত্ত্বেও বংশধারা বয়ে নিয়ে যাওয়ার তথ্য মিলেছে। রোগও বংশগত হয়, এই নিয়মের ধারায় পড়েই। যা অস্তিত্বকেই জন্মান্তরের প্রবাহে এগিয়ে নিয়ে চলা।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
জেনেছিলাম মহিলাদের চেয়ে পুড়তে বেশি দেরি হয় পুরুষদের দেহ। এটা পরীক্ষিত সত্য। এছাড়াও যারা দীর্ঘদিন বিছানায় পরে রোগে ভোগে তাদের দেহও পুড়তে দেরি হয়। এমনি সাধারণ ভাবে হঠাৎ কেউ মারা যাওয়া মানুষের দেহকে পোড়াতে সময় লাগে ২ ঘণ্টার একটু বেশি। এই দু’ঘণ্টা সময়ের মধ্যে কাঠে, কিংবা কয়লাতে পোড়ালে নাভির অংশ ছাড়া বাকি সবই পুড়ে যায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মৃত্যুর পর আপনার নিথর দেহটি পড়ে থাকে, সাংসারিক প্রিয়জনদের উঠানে। কান্না, শোক, তাপের ভিতর দিয়ে সেখানেই একশ্রেণির মানুষ আপনার বিচার শুরু করে। সেই বিচারশালায় আপনার কর্মময় ব্যবহারিক দিকটিই উঠে আসে। আলোচিত হয় আপনার জীবনময় প্রবাহিত ভালো, মন্দ– নানা গুণের কথা। তারপর দাহকার্যে নিয়ে যায় দেহ, প্রিয়জনদের দল। হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ মানুষই মৃতদেহ দাহ করে শ্মশানে, প্রাচীন কালে নদীতটে দাহ করা হত। এখনও রাঢ় বাংলার গ্রামের দিকে বহুগ্রাম্য শ্মশান রয়েছে নদনদীর তীরেই। কেবলমাত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের বৈরাগী, বৈষ্ণব আর সাধকের দেহ পোড়ানোর কোনও রীতি নেই। মুসলমানরা কবর দেয়। হিন্দুদের মাল, আদিবাসীদের অনেকেই পয়সার অভাবে দাহ করতে না পেরে মৃতদেহ সমাধি দেয়।
নানা রীতিনীতির দেশ এই ভারত। বাংলাতেও বিচিত্র সংস্কৃতির সংমিশ্রণ দেখতে পাওয়া যায়, শব সৎকাজকে ঘিরে। আর সেই আচারবিচারের আঙিনায় রয়েছে শববহনকারী বা শববাহকদের ঘিরে নানা লোকাচার। প্রাচীনত্বের সেই লোকাচারের একটি দীর্ঘ প্রেক্ষাপট রয়েছে বাংলায়। গ্রাম্যতা-মাখানো সে লোকাচারের গন্ধে অনেকটা মাটি, অনেকটা প্রকৃতি, অনেকটা গাছ, পাখি, ফুল, নদী আর বাস্তুভিটার গন্ধের সঙ্গে মেখে থাকে ছোট ছোট বিশ্বাসবোধ আর হারানো প্রিয়জনদের স্মৃতির গন্ধ। চেনাজীবনের অচেনা যাপনের বাঁকে কখনও কখনও তাদের উপস্থিতি ঘটে। রাঢ়ের টুমুনি নদীর তীরে রয়েছে ছোট ছোট শ্মশান। বালিজুড়ি, গোগলা গ্রামের পাশে টুমুনি তীরে শ্মশান আর পাশেই কয়লাখনির প্রাক্তন অফিসার, লোকসংস্কৃতিপ্রেমী সোমনাথ দাস চাণ্ডিল্যের ‘গোঁসাই বাগান’। সংস্কৃতিচর্চার পীঠস্থান, একিনী পুজোর বৈষ্ণব গোঁসাই-এর আটনকে ঘিরে। আশ্চর্য হতে হয়, একদিনের আতঙ্কের শ্মশানভূমিতে বর্তমানে সংস্কৃতির চর্চা! মায়া, মোহমাখা জীবনের এমন মুক্তি দেখা যায় না। পশ্চিম বর্ধমানের আরও এক বিখ্যাত শ্মশান রয়েছে বীরভানপুরে দামোদরের চড়ে। দুর্গাপুর ব্যারেজের ঠিক পশ্চিমে। শান্ত, স্নিগ্ধ তবে মৃতদেহ পোড়ানোর বড় চাপ এখানে। বাঁকুড়ার পাশাপাশি দুই বর্ধমানের বহু মৃতদেহকে এখানে পোড়াতে নিয়ে আসেন, মানুষজন। বৈদ্যুতিক চুল্লি রয়েছে এখানে। করোনা কালে এ শ্মশান হয়ে উঠেছিল মৃত্যুপুরী। বিচিত্র গ্রামের মানুষজনরা নানারকমের শোকগান করতে করতে এখানে মৃতদেহ আনেন।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
কয়লাকুঠির বিখ্যাত সাহিত্যিক, চিত্র-পরিচালক শৈলজানন্দ, পশ্চিম বর্ধমান জেলার অণ্ডাল গ্রামের মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর তিন বছর বয়সে মায়ের মৃত্যুর পর পশ্চিম বর্ধমানের (অণ্ডাল গ্রামের) মামাবাড়িতে দাদামশাই রায়সাহেব মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের কাছে তিনি বড় হন। দাদামশাই ছিলেন ধনী কয়লা-ব্যবসায়ী। দাদামশাই তাঁকে বিকেলবেলায় সঙ্গে করে গ্রামের শ্মশানের মায়াভূমি দেখাতে নিয়ে যেতেন। পরবর্তীতে রানীগঞ্জ শিহারসোলে স্কুল জীবনে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের গভীর বন্ধুত্ব হয়। তিনি বন্ধুকে বলতেন, মা হারানোর কথা, ছেলেবেলার শ্মশানভূমি দেখার কথা! তাঁর স্মৃতিতে বার বার ঘুরেছে শ্মশানভূমি এবং তার রহস্যঘন নিবেদনটুকু।
হরি বল হরি বল হরি বল ভাই,
হরি নাম ছাড়া জীবের আর গতি নাই।
রাঢ়ের বিভিন্ন শ্মশানকে ঘিরে রয়েছে নানা গল্প, মিথ। শববাহকেরা শ্মশানে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার পথে, নানা রকমের গান করে। বৈচিত্রময় সেসব গানে অন্তর আত্মার নিবেদনটুকু থাকে লুকিয়ে। বাংলা জুড়ে গ্রাম ও শহরে রয়েছে শ্মশানঘাট। তাকে ঘিরে গল্পে ও ইতিহাসের মাহাত্ম্যকথাও রয়েছে নানারকমের। যেমন বীরভূমের জয়দেব কেন্দুলিতে রয়েছে বিখ্যাত শ্মশান। অজয় তীরের তমালতলির সেই প্রাচীন শ্মশানের নাম কদমখণ্ডী ঘাট। এই কয়েক বছর সেখানে সরকারিভাবে শবদাহ মন্দির নির্মিত হয়েছে। অতীতে ছিল না। ফাঁকা অজয়পারেই দাহ করা হত। পশ্চিম বর্ধমানের কাঁকসার বনকাটির পাষাণচণ্ডী অজয় ঘাটের শ্মশানও বেশ প্রাচীন ও ইতিহাস বহুল। রাজা বল্লাল সেনের ধর্মগুরু চণ্ডীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশ থেকে নদীপথে এসে, অজয়ের প্রাচীন নৌ-বন্দর পাষাণচণ্ডী ঘাটেই নামেন।
গঙ্গার উদ্ধারণপুরের শ্মশান ঘাটের বিরাট মাহাত্ম্য রয়েছে। বহু মিথ ও গল্পকথাও রয়েছে জড়িয়ে। রাঢ়ের কুনুরের তীরে বিভিন্ন শ্মশানে, যেমন গোয়ালআড়া, গেঁড়াই, মাজুরিয়াতে দাহ হয় মানুষজন। বীরভূমের তারাপীঠের দ্বারকা নদীর মহাশ্মশান ঘিরেও রয়েছে অলৌকিকতা ঘেরা গল্পের সরণি। বোলপুর শহর লাগোয়া কংকালিতলা মহাশ্মশানেরও প্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে। শবদেহ দাহ কাজে যুক্ত ডোমরা অনেকেই বলেন, সৎকাজের টুকটাক অনুষঙ্গ নিয়ে নানা কথা। রাঢ়ের বিখ্যাত শ্মশান ডোম শ্রীদাম শবদেহ কাজে যুক্তি ৬৭ বছরেরও বেশি সময়। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার নানা কথা বলেন, আমাকে। তাঁর থেকেই জেনেছিলাম মহিলাদের চেয়ে পুড়তে বেশি দেরি হয় পুরুষদের দেহ। এটা পরীক্ষিত সত্য। এছাড়াও যারা দীর্ঘদিন বিছানায় পরে রোগে ভোগে তাদের দেহও পুড়তে দেরি হয়। এমনি সাধারণ ভাবে হঠাৎ কেউ মারা যাওয়া মানুষের দেহকে পোড়াতে সময় লাগে ২ ঘণ্টার একটু বেশি। এই দু’ঘণ্টা সময়ের মধ্যে কাঠে, কিংবা কয়লাতে পোড়ালে নাভির অংশ ছাড়া বাকি সবই পুড়ে যায়। এসব নানা কথা বলেন তিনি! তবে তিনিই বলেন, ‘অল্পবয়স্ক ছেলে, মেয়েদের পোড়াতে গেলে খুব কষ্ট হয় বাবা। কয়েকজনকে পোড়াতে গিয়ে খুব কষ্ট হয়েছে। আমার বন্ধুদের, দাদাকে আজও ভুলতে পারি না। নিজের জন্ম দেওয়া ছেলেকেও পোড়াতে হয়েছে বাবা! ঈশ্বর আরও যে কী কী করাবে, এ জীবনে!’
মঙ্গলকোটের নিখিল সর্দার, বাঁকুড়ার ভজাই লোহারের ব্যবসা আছে আইসক্রিমের, তারা তা বন্ধ করে চলে যায় শ্মশানে। পশ্চিম বর্ধমানের কাঁকসার অযোধ্যার তপন চ্যাটার্জির বাড়ি বাড়ি পুজোপাঠ রয়েছে। সেই পুজোপাঠ ফেলে তাঁরা চলে যান শ্মশানে। বর্তমানে ভয়কে জয় করে, বাংলার বহু শ্মশানেই আশ্রম তৈরি হয়েছে। অনেক শ্মশানকে ঘিরে পর্যটনের রমরমা তৈরি হয়েছে। অনেক শ্মশানেই থাকছেন সংসারী ও সংসার ত্যাগী মানুষজনরা। কোথাও কোথাও সাধকরা এসে থাকছেন। এমন কিছু মানুষ আছে, যারা সাহসিকতা সর্বোচ্চ গণ্ডিটাও টপকাতে জানে; তাদেরও অবাদ বিচরণক্ষেত্র শ্মশানভূমি।
পূর্ব-বর্ধমানের মঙ্গলকোটের চানক গ্রামে রয়েছে বামুনপুকুর, ন’পুকুরের মতো মহাশ্মশান। রসুনিয়া জয়পুরের এক সাধু এখানে এসেছিলেন বহুদিন। তাঁর নাম শম্ভু সাধু। তিনি খুব ভালো শববাহকের গান করতেন। তার বাঁধা কলিতে সেসব গান বেশ জনপ্রিয় হয়েছে পরবর্তীকালে। পরে বীরভূমের সিউড়ির কোনও এক গ্রামের শ্মশানে গিয়ে, আশ্রম গড়ে সেখানেই দেহ রাখেন তিনি। মঙ্গলকোটের আরও এক গ্রাম, জালপাড়ার শ্মশানমোড়, জঙ্গলঘেরা সতী মায়ের আশ্রম। সেখানেই থাকেন স্বপন বাবাজি। এই শ্মশানের একটি নাম রয়েছে। অনেকে ‘হর-পার্বতীর শ্মশান’ বলে। অনেকে বলেন, ‘সতীমাতার শ্মশান’। এ থেকেই জানা যায়, এখানে সতীদাহ হয়েছিল, কোনও একসময়ে। সে থেকেই সতীমাতার শ্মশান নামে খ্যাত, এই পবিত্র শ্মশানভূমি। পার্শ্ববর্তী আউশগ্রামের গুসকরা শহরে রয়েছে কুনুর নদীর তীরে, রটন্তী তলার মহাশ্মশান। সেবাইত খোকা চোংদার। কুনুর নদীর তীরের, সেটিও একটি মহাশ্মশান। এখানকার শববাহকেরা তারকব্রহ্ম নাম গেয়েই মৃতদেহ শ্মশানে আনে।
জীবনের প্রেম নিয়ে প্রহর দীর্ঘ হোক…
আউশগ্রামের বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে অনেকগুলি শ্মশান, মহাশ্মশান। মাহাত্ম্যতে এ-ওকে টপকে দেয়। বহু শ্মশানের গভীরে, শোকযাত্রার গানে নানা বৈচিত্র রয়েছে। আউশগ্রামের বিষ্ণুপুরের শ্মশানের নাম ‘চুরচুরে বাঁধ’। ক্যানেল ডিভিসি আর কুনুর নদীর পাশে পরে। গ্রামের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে রয়েছে এই শ্মশানটি। এই শ্মশানের প্রতিষ্ঠাতার নাম জানা যায় না। একসময় গ্রামে জাতি ছিল কামার, কুমড়ো, তাঁতি, ময়রা, ব্রাহ্মণ, সদগোপ, সুঁড়ি, বাগদী, আঁকুড়ে, বাদ্যকর, নাপিত, মুসলমানেরাও আছে গ্রামে। তারাও শ্মশানবন্ধুদের গান করতে পারে। এখানকার মুসলমানরাও করে শববাহকের গান। এখানকার বৈষ্ণব দলও গান গায় শ্মশানবন্ধুদের গান ‘বল হরি বল’। তারাও শ্মশানে শববাহকের সাজে যায়। আউশগ্রামের গোপালপুর উল্লাসপুরের হাবল দাস বৈরাগ্য বৈষ্ণব হয়েও শ্মশানে যায়। শববাহকের সাজে মৃতদেহর সঙ্গে গিয়ে, গান করে শোকগান। এখানকার আট-দশখানা গ্রামের শ্মশানভূমি এই কলাভবনের কমলকৃষ্ণ মহাশ্মশান। শববাহকের দল শববাহকের গান করলেও, দাহকার্যের পর রাত্রি হয়ে গেলে কেউ আর এই শ্মশানে থাকে না। তখন নাকি ভয়ংকর হয়ে ওঠে এই শ্মশান। এই শ্মশান থেকে মৃতদেহ সৎকাজ করে ফেরার পথেও, শববাহকেরা শোকগান করতে করতে ফিরে আসে। এটাই রীতি। তখন ঘরজুড়ে প্রিয়জনদের কান্নার রোল।

The post বাংলার প্রাচীন শ্মশানবন্ধুদের বিয়োগব্যথার গান appeared first on Robbar | Sangbad Pratidin.


Viewing all articles
Browse latest Browse all 110

Trending Articles