Quantcast
Channel: পাঁচমিশালি Archives - Robbar | Sangbad Pratidin
Viewing all articles
Browse latest Browse all 109

ইনস্টাগ্রামে উল্লসিত জঙ্গলমহলের দেওয়ালচিত্রে, কিন্তু সংস্কৃতি বাঁচছে?

$
0
0

হেমন্তের ভাপ নিয়ে এসেছিল শীত। শীতের ইনিংস এখন শেষের পথে। হেমন্ত ও শীতের একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে রাঢ়বঙ্গে। মুহূর্তের চিহ্নগুলি ধরা থাকে কোথাও, বিবিধ বিন‌্যাসে। আবার অনেক সময়ই অব‌্যবহারে হারিয়ে যায়। দূরত্ব বুনে প্রসঙ্গ তার অনিবার্য হয়ে ওঠে। আম বাঙালির কাছে ‘অচেনা’ পৃথিবী হলেও জঙ্গলমহলে হেমন্তের মূল সুর বেঁধে দেয় বাঁদনা, সহরাই পরব। শীতও সেই সব পরবের বিচরণকাল। চরাচরে বুনন হয় বহু কাহিনি। যার বৃহদংশ থেকে যায় অপ্রকাশিত।

বাঁদনা, সহরায়ে আদি সংস্কৃতির আবহ থাকে জঙ্গলমহলের বনে-বাদাড়ে। এ এক অন‌্য আত্ম-পরিচয়। যা সঞ্চরণশীল। কোনও ধ্রুবত্বের ধারণা নিয়ে একটি নিরক্ষর মহিলা মাটির দেওয়াল জুড়ে বনজ ফুল-উদ্ভিদ, পশু-পাখি বা দৃশ‌্য-সংস্কৃতি আঁকতে যায় না। কোনও কিছুকে বিস্মৃত হতে না দেওয়ার অবস্থানে নিজেকে সঁপে দেয় দেওয়ালের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। এক একটি দেওয়াল হয়ে ওঠে মরমি ক‌্যানভাস। যার মেজাজ আলাদা। নিজস্ব অ-জাগতিক কর্ম একটি নারীর অবচেতনে নিহিত।

জনজাতিদের নিজের ‘ওয়াল’ (দেওয়াল) রাঙানো বা আঁকিবুকি সংস্কৃতি আজকের নয়। আদিকাল থেকে প্রবাহিত। এবং কালক্রমে এসেছে নানা প্রাকৃতিক উপাদান। রঙের ক্ষেত্রে অর্গ‌্যানিক ব‌্যবহার। লতা-পাতা বেঁটে রঙের নিরীক্ষা। রাসায়নিক এক প্রকার নিষিদ্ধ (যে গৃহে নুন বাড়ন্ত থাকে– সেই গৃহের রমণীর কাছে রাসায়নিক পদার্থ কেনা বিলাসিতা মাত্র)। চিত্রিত গ্রাম যেন পদব্রজ করেছেন কোনও দক্ষ শিল্পী। ঘরের দুয়ার, চালা-বারান্দা-উঠোন-দাওয়া (কুলহির পিঁড়হা) যেন কোনও আশ্চর্য হাত গড়েছে। দেওয়াল চিত্রে হয়তো অ্যাবস্ট্রাক্ট  থাকে না। কিন্তু দৃষ্টিনন্দন তো বটেই।

জঙ্গলমহলে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়েছে। বেড়াতে এসে আদিবাসী গ্রামের দাওয়ায় বসে পোজ দেন। মোবাইলে ছবি ওঠে দেদার। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে সেই সব ছবিতে আবার হাজার, দু’হাজার লাইক পড়ে। পর্যটকদের ছবি তোলা দেখে আড়ালে মুচকি হাসে বাহা টুডুর মা। প্রাণময় যে ছবি– তার সৃজনশিল্পীর খোঁজ নেয় না কেউ। এতে অবশ‌্য কোনও বিষাদ বা খেদ নেই আদিবাসী রমণীটির। ছবির মধ্যেই সে বুনে দিয়েছে পরম্পরা। একদিন বড় হয়ে বাহাও হয়ে উঠবে যোগ‌্য সৃজক। তার হাতের চলন বংশ পরম্পরায় অব‌্যাহত থাকবে। এই প্রত‌্যয়ে জন্মান্তর খোঁজে বাহার মা। তবে এখন সিঁদুরে মেঘ আদিবাসী অধ‌্যুষিত গ্রামে।

কবি অরুণকুমার চক্রবর্তী হুগলির চুঁচুড়ার বাসিন্দা ছিলেন। ১৯৭২ সালে শ্রীরামপুরে স্টেশনে একটি মহুল গাছ ও ফুল দেখে বেমানান মনে হয়েছিল কবির। তিনি রচনা করেন ‘লাল পাহাড়ির দেশে যা’। এই গানের কথাগুলি একটু উল্টে-পাল্টে ধ্বনিত হচ্ছিল পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডির বিরসা হেমব্রমের কণ্ঠে । সে গানটি গাইছিল নিজের গ্রামের একটি আবাস যোজনার বাড়ির সামনে– ‘হেতেক তকে মানাছ্যে নাই রে!’ গানের সুর-লয়-তাল অপরিবর্তিত হলেও বিরসার মুখে দ্রোহের অভিব‌্যক্তি। বস্তুত, আদিবাসী অধ‌্যুষিত গ্রামে বড় বেমানান আবাস যোজনার গৃহ। কারণ আবাসের ঘরগুলি একটি নির্দিষ্ট কাঠামোয় নির্মাণ হয়। ছাদ ঢালাইয়ের। দেওয়ালে সিমেন্টের প্লাস্টার। এইসব দেওয়ালে মহিলাদের আঁকিবুকি চলে না। গ্রামের শোভা বর্ধন নয় বরং শোভা-বর্জন করছে। তাই রব উঠছে ‘তকে মানাচ্ছে নাই রে!’…
প্রশ্ন উঠবে তাহলে আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামের গরিব পরিবার আবাস যোজনায় গৃহ নেবে না? নিশ্চয়ই নেবে। আর্থিক মানদণ্ড বিচার্যে আদিবাসীদের আবাসের গৃহ বণ্টন অবশ্য কর্তব্য প্রশাসনের। সরকারি সহায়তায় মজবুত গৃহ গড়ে উঠুক। কিন্তু তার জন্য ফিল্ডওয়ার্কটা জরুরি। গঙ্গাপাড়ের সাততলা বা দশতলায় বাতানুকূল ঘরে বসে পরিকল্পনা করলে যা হওয়ার, তাই হয়েছে। মাথার উপরে ছাদ দিতে গিয়ে আদিবাসীদের স্বকীয় সংস্কৃতি বিপন্নতার মুখে।

বর্তমানে আবাস যোজনায় একটি গৃহ নির্মাণের জন্য তিনটি ধাপে মোট এক লক্ষ ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয় (প্রথম দফা ৬০০০০, দ্বিতীয় দফায় ৬০০০০ ও তৃতীয় দফায় ১০০০০ টাকা)। সরকারি নিয়ম অনুসারে উপভোক্তা নিজেই বাড়ি নির্মাণ করবেন। নির্মাণ কাজে ১০০ দিনের প্রকল্পে মজুরিও মেলে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে ছবিটা ভিন্ন। একটি ব্লকে ধরা যাক, ১০ হাজার বাড়ির অনুমোদন এসেছে। অভিযোগ ওঠে, ব্লকের সবক’টা বাড়ি নির্মাণের দায়িত্ব একজন ঠিকাদারকে বরাত দেওয়া হয়। ঠিকাদার এর বিনিময়ে মোট বরাদ্দকৃত অর্থের একটা শতাংশ শাসকদলের নেতাদের ও প্রশাসনিক কর্তাদের উৎকোচ দেন। বাড়ি নির্মাণে উপভোক্তাকে কোনও হ্যাপা পোহাতে হয় না। উপভোক্তার বাড়িটি হয় সরকারি নির্দিষ্ট ধাঁচে। বাড়ির সামনে উপভোক্তা নিজের ছবি তুলে প্রশাসনের কাছে পাঠায়। বাড়ির দেওয়ালে আবার লিখতে হয় আবাস যোজনায় পাওয়া বাড়ি, ইত্যাদি। থাকে জিও ট্যাগ।

 

আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামে আবাসের গৃহ মানানসই করতে কী করা উচিত? প্রথমত, উপভোক্তাদেরই নিজস্ব ধাঁচে বাড়ি নির্মাণের স্বাধীনতা দেওয়া যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, বাড়ির ছাদ ঢালাই হবে কি হবে না, নাকি টালি-খাপরার চাল হবে সেটা উপভোক্তা সিদ্ধান্ত নেবেন। তৃতীয়ত, ঢালাইয়ের ছাদ হলেও টালির-চালের মতো করা যায়। সেটা উপভোক্তা ভাল-মন্দ বিচার করুক। চতুর্থত, বাড়ির ভেতরে পাকা হলেও বাইরের দেওয়ালে মাটির প্রলেপ দেওয়া যায়। তাতে ক্ষতি হয় না বাড়ির। সেই মাটির প্রলেপ দেওয়া দেওয়ালে আদিবাসী রমণী আঁকিবুকি করতে পারবেন। পঞ্চমত, উপভোক্তা বাড়ি নির্মাণ করছেন কিনা টাকা অন্যত্র করছেন তা নজরদারি করুক প্রশাসন (সরকারি নিয়ম অনুসারে আবাস প্রকল্পে নজরদারি চালানোর জন্য টিম রয়েছে)। বাংলা আবাস যোজনায় সারা রাজ্যে ১২ লক্ষ বাড়ি হচ্ছে এবার। জঙ্গলমহলে (পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-ঝাড়গ্রাম) সেই সংখ্যাটা দেড় লক্ষের বেশি। এর মধ্যে ধরেই নেওয়া যাক ৩০ শতাংশ বাড়ি হচ্ছে অধিবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে। অর্থাৎ ৪৫ হাজার বাড়ি আবাসের ধাঁচে। আদিবাসী ভুবনে বড় বেমানান ঠেকবে না? একটি গ্রামে ১০টি এমন আবাসের বাড়ি হলেই ছবিটা বদলে যাবে গ্রামের। বাঁদনা, সহরাই আসবে যাবে, মাটির দেওয়াল হারিয়ে যাবে। মহিলারা কার দেওয়ালে আঁকবে? দেওয়াল জুড়ে ওঁদের হাতের চলন স্তব্ধ হয়ে যাবে? হারিয়ে যাবে আদিবাসীদের সংস্কৃতি? চিত্রিত দেওয়ালও কি ঠাঁই নেবে জাদুঘরে?

এক অস্থির সময়ে দাঁড়িয়ে আজকের বিরসা, বাহারা। যে জীবনগাঁথা লালিত হয়ে এসেছে, সেখানে আজ শঙ্কার ঘনঘটা। দৃশ‌্যমান সংস্কৃতিই অস্তিত্ব সংকটে। বীরসাদের আজও জীবন জাঁতাকলে। এই জাঁতাকলের ভার ও ধার দুটোই তর্কাতীত। ফি বছর বিরসা মুন্ডার জন্মদিন ও হুল দিবস পালনে ‘মহাযজ্ঞ’ দেখা যায়। কিন্তু ক’জন খোঁজ রাখি আজকের বিরসাদের? তারা ঠিক কী চায়? নাকি তথাকথিত ‘সভ‌্যরা’ সব কিছু চাপিয়ে দিতেই অভ‌্যস্ত? ঠেলে দিতে চায় সাংস্কৃতিক বিপন্নতার দিকে, মৌলিক সাংস্কৃতিক বিমুখতার দিকে। আর যখন পিছোতে পিছোতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে, তখন দ্রোহের ধ্বনি ধ্বনিত হবে না, উলগুলান জাগবে না, তার নিশ্চয়তা তো থাকে না।

ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত, লেখক সূত্রে প্রাপ্ত

The post ইনস্টাগ্রামে উল্লসিত জঙ্গলমহলের দেওয়ালচিত্রে, কিন্তু সংস্কৃতি বাঁচছে? appeared first on Robbar | Sangbad Pratidin.


Viewing all articles
Browse latest Browse all 109

Trending Articles