Quantcast
Viewing all articles
Browse latest Browse all 115

বেগুনি রংটা বাস্তবে কোনও অস্তিত্ব নেই, গোটাটাই একটা কাল্পনিক নির্মাণ

আখেরে গোলমেলে রং। বরাবরই রহস্যে মোড়া। সূর্যাস্তের কাছাকাছি সীমান্তের রঙের মতো। চামড়ায় লেগে থাকা নাছোড়বান্দা কালশিটের মতো। খানিকটা আশঙ্কাজনক। অজানা ভবিষ্যতের অস্বস্তিপূর্ণ উৎকণ্ঠার মতো। প্রকৃতিতে বিরল। তাই হয়তো আবেদনও খানিক অপ্রতিরোধ্য। নিরো তার সাম্রাজ্যে এই রঙের বিক্রি নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। মোনে লিখেছিলেন, ‘আমি অবশেষে বায়ুমণ্ডলের প্রকৃত রং আবিষ্কার করেছি। তা বেগুনি। শুদ্ধ বাতাসের রং আখেরে বেগুনি।’ কল্পনার আজগুবি রং। তরিৎচুম্বকীয় তরঙ্গের দৃশ্যমান অংশটুকুর দুই প্রান্তের দুই রং– লাল আর নীল– দীর্ঘতম আর ক্ষুদ্রতম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের নিঁখুত ভারসাম্যে তৈরি হওয়া ম্যাজিক রং। হয়তো সেজন্যই দ্ব্যর্থক… হয়তো সেজন্যই কোনও সুষ্পষ্ট আবেগের সঙ্গে তাকে বাঁধা মুশকিল। অন্ধকারের মতো কালো, রক্তের মতো লাল, সূর্যের মতো হলুদ– বেগুনি ঠিক কার মতো? ইতিহাস যত এগিয়েছে, এ প্রশ্নের উত্তর বদলেছে তার চেয়েও দ্রুতগতিতে!

Image may be NSFW.
Clik here to view.

শুরুটা নিশ্চিতভাবে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বের মেসোপটেমিয়ায়। ফোনেশিয়ার সমুদ্রতটে এক বিশেষ জাতের সামুদ্রিক শামুকের খোলস গুঁড়ো করে, তার শরীরের এক বিশেষ গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত বিষাক্ত শ্লেষ্মাকে লবণাক্ত জলে দ্রবীভূত করে টানা তিনদিন নিভু আঁচে জারিয়ে তৈরি হত সেই বেগুনি-টাইরিয়ান পার্পল। প্লিনি সে রংকে অন্ধকার আর জমাট বাঁধা রক্তের রঙের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। এবং সে রং তৈরির প্রক্রিয়াটিও ভয়াবহ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। আর তার চেয়েও বড় কথা, মাত্র এক গ্রাম গুঁড়ো রং তৈরি করতে প্রায় দশ হাজার শামুকের প্রয়োজন! ফলে তার দামও আকাশছোঁয়া। এমন মহার্ঘ্য বলেই হয়তো লোকমুখে সে রঙের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল দূরদূরান্তে– পারস্য, গ্রিস হয়ে কালে কালে রোমেও। এমনকী ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে, প্রাচীন সুমেরীয় ভাষায় ‘ফোনেশিয়া’ শব্দটির আদি অর্থও ‘দ্য ল্যান্ড অফ পার্পল’।

Image may be NSFW.
Clik here to view.
Tulip Field | Flower Gardens | Flowers | Pixoto

প্রবাদপ্রতিম সে বেগুনি রং সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে ছিল। কিন্তু একাধিক সাম্রাজ্যের রাজসভা আলো করে থাকত টাইরিয়ান পার্পল। রাজকীয় রং। এমনকী ক্যালিগুলার আমলে নিয়ম করে জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য এ রংকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। সেনেটের উচ্চপদাধিকারীরাও বড়জোর তাদের পোশাকে এক ফালি বেগুনি পার ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছিলেন। আর সাম্রাজ্যের একজনই পুরোদস্তুর বেগুনি টোগায় সর্বাঙ্গ ঢাকার অধিকারী ছিলেন– তিনি স্বয়ং সিজার! বাইজান্টাইন সভ্যতা আরও একধাপ এগিয়ে বেগুনিকে সরাসরি সরকারি রং হিসেবে শিলমোহর দেয়। ও রং কেবল সম্রাটকেই মানায়। সম্রাট দ্বিতীয় থিওডেসিয়াসের আমলে কোনও সামান্য প্রজা টাইরিয়ান পার্পল কেনার ঔদ্ধত্ব দেখিয়েছে– এ অপরাধে সে হতভাগ্যের কপালে মৃত্যুদণ্ড জোটাও অসম্ভব ছিল না। বেগুনি তখন এক নিষিদ্ধ রং। এবং আর পাঁচটা নিষিদ্ধ জিনিসের মতোই তাকে নিয়ে জল্পনাও তুঙ্গে।

Image may be NSFW.
Clik here to view.

পরিস্থিতি বদলাতে অপেক্ষা করতে হয় উনিশ শতক পর্যন্ত। শিল্প বিপ্লব পরবর্তী ইউরোপে সেটা আবিষ্কারের যুগ। উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় গুঁড়ো রং তৈরি করার হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। রাসায়নিক রং বেশ সস্তা আর গবেষণাগারে গণহারে তৈরি করতেও খুব একটা বেগ পেতে হয় না। উজ্জ্বল, চোখ ঝলসানো সব রং–যেমনটা এর আগে কল্পনাও করা যেত না– তেমন সব রং অবলীলায় শিল্পীদের ক্যানভাস আর কেতাদুরস্থ ভিক্টোরিয়ানদের পোশাকে উঠে আসছে। অবশ্য ১৮৫৬-র সেই দৈবাধীন দিনটিতে তরুণ গবেষক হেনরি পার্কিন তাঁর নিজস্ব গবেষণাগারে রং তৈরির চেষ্টা করছিলেন না। ১৮ বছরের সেই তরুণ আখেরে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় কুইনাইন তৈরি করতে চেয়েছিলেন। ম্যালেরিয়ায় মহৌষধখানি তখনও শুধুমাত্র দক্ষিণ আমেরিকার এক বিরল গাছ থেকেই নিষ্কাশন করা হত। কৃত্রিম কুইনাইন বাজারে এলে তা যে শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিপ্লব আনবে, তা নয়– আবিষ্কর্তাও যে পেটেন্টের পয়সায় ফুলেফেঁপে উঠবেন, তা বলা বাহুল্য। কিন্তু অ্যানিলিন আর পটাশিয়াম ডাইক্রোমেট সালফেটের আকস্মিক বিক্রিয়ায় কুইনাইনের বদলে পার্কিন এক আশ্চর্য উজ্জ্বল বেগুনি রঙের সন্ধান পেলেন। বাকিটা ইতিহাস। ফ্যাশন সাম্রাজ্ঞী হিসেবে পরিচিত ফ্রান্সের রানি ইউজিনির সিল্কের পোশাক থেকে রানি ভিক্টোরিয়ার ভেলভেট গাউন– বেগুনির ‘ফ্যাশনেবল’ হয়ে ওঠা অনিবার্য ছিল! আর সভ্যতায় এযাবৎ নিষিদ্ধ সেই রংখানি সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে চলে আসায় বেগুনি নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি পড়ে গেল! তার আধুনিক ‘মভ’ নামক ফরাসি পরিচয়টির আমদানিও সে সময় ফ্রান্স তথা সমগ্র ইউরোপের যত্রতত্র ফুটে থাকা লাইল্যাক ফুলের নামে। ফরাসি না জানলেও পার্কিন অবিলম্বে তার নিজস্ব বেগুনিটিকে ‘মভ’ নামে চিহ্নিত করলেন! এরপর সে রং নিয়ে যা ঘটল, তাকে ইতিহাস ‘মভ ম্যানিয়া’ নাম দেবে।

Image may be NSFW.
Clik here to view.

 

চার্লস ডিকেন্সের নিজস্ব ম্যাগাজিন ‘অল ইয়ার রাউন্ড’-এর ১৯৫৯-এর এক সংখ্যায় বেগুনি রং নিয়ে ভিক্টোরিয়ানদের সে উন্মাদনার একঝলক পাওয়া যায়। লেখকের নিজস্ব জবানিতে… ‘জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি… খোলা জুড়িগাড়ি থেকে বেগুনী সব হাত নড়ছে… দরজায় দরজায় বেগুনী হাতগুলো করমর্দন করছে– রাস্তার দুদিকে দুই বেগুনী হাত একে অন্যকে হুমকি দিচ্ছে– বেগুনি সব পোশাক এক্কাগাড়ীতে ভিড় জমাচ্ছে, ক্যাবের ঠাসাঠাসি হয়ে আছে, স্টিমারের শ্বাসরোধ করছে, রেলওয়ে স্টেশনগুলো ছেয়ে রয়েছে… জানলায় জানলায় বেগুনী রিবন ঝুলছে, দোকানের দরজায় দরজায় বেগুনি গাউন, খোলা জানলা থেকে বেগুনী হাতপাখা আমাকে ইশারা করছে। মনে হয় খুব শিজ্ঞিরি বেগুনি ওমনিবাস আর বেগুনি বাড়ীঘরও দ্যাখা যাবে…’। প্রবল জনপ্রিয় ‘পাঞ্চ’ ম্যাগাজিন ভিক্টরিয়ানদের এই বেগুনি প্রীতিকে এক সংক্রামক রোগের সঙ্গে তুলনা করেছিল। সে রোগের প্রাথমিক উপসর্গ-পোশাকে বেগুনি রিবনের আচমকা আবির্ভাব। তারপর অনতিবিলম্বেই দেখা যায় রোগীর সর্বাঙ্গ বেগুনি রঙে ভরে গেছে! লেখক সাবধান করেন– ‘অন্যান্য ছোঁয়াচে রোগের মতই এই বেগুনি উন্মাদনা ভয়ানক সংক্রামক: এমনকী এমন দৃষ্টান্তও বিরল নয় যেখানে গৃহকর্ত্রীর এই রোগটি হওয়ার এক হপ্তার মধ্যে দ্যাখা গ্যাছে– গোটা পরিবারই এই রোগে আক্রান্ত!’

Image may be NSFW.
Clik here to view.

বেগুনি তখন উন্মাদনার রং। কিন্তু উন্মাদনা মাত্রেই কিঞ্চিৎ আশঙ্কাজনক। প্রযুক্তির হাত ধরে নাগরিক সভ্যতার তড়িৎ অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের অভিধানে ‘দূষণ’ নামের একটা নতুন শব্দ ঢুকে পড়েছে। ইউরোপের শহরগুলো সারাদিন কারখানার কালো ধোঁওয়ায় ঢেকে থাকে। রাতে গাঢ় ধোঁয়াশায় পথঘাট অদৃশ্যপ্রায়। কেউ কেউ সন্দেহ করা শুরু করেছেন– লাগামছাড়া এই উন্নয়নে সভ্যতা ঠিক কোথায় গিয়ে পৌঁছবে? ডিস্টোপিয়া-ধর্মী কল্পবিজ্ঞানের উদ্ভবও প্রায় একই সময়ে। আর অন্ধকারাচ্ছন্ন সেইসব ভবিষ্যতের পৃথিবীতে অশুভ টোটেমের মতো বেগুনির উপস্থিতি। এইচ. জি. ওয়েলস-এর ‘দ্য পার্পল পাইলিয়াস’ গল্পের হতভাগ্য স্বামী এক বেগুনি হ্যালুসিনোজেনিক খাওয়ার পর তার গোটা চরিত্রই বদলে যায়। ফ্রেড ওয়াইটের ‘দ্য পার্পল টেরর’ কাহিনিতে একদল মার্কিনি সেনা কিউবার জঙ্গলে এক মানুষখেকো বেগুনি অর্কিডের খপ্পরে পড়ে। ফ্রেড জেনের ‘দ্য ভায়োলেট ফ্লেম’-এ এক উন্মাদ বিজ্ঞানী তাঁর গবেষণাগারে এমন এক বেগুনি রাসায়নিক আবিষ্কার করেন, যাকে বিস্ফোরক হিসেবে ব্যাবহার করা সম্ভব। ভয়ংকর সেই বিস্ফোরক দিয়ে এরপর তিনি ওয়াটারলু স্টেশনকে নিশ্চিহ্ন করে দেন। এম. পি. শিলের ‘দ্য পার্পল ক্লাউড’ উপন্যাসের একাকী নায়ক উত্তর মেরুর আকাশে এক থমথমে বেগুনি মেঘের দেখা পাওয়ার পর ক্রমে টের পায় এক বিষাক্ত বেগুনি ধোঁয়ায় গোটা মানবসভ্যতাই ধ্বংস হয়ে গেছে। সেই রহস্যময় ধোঁয়া হিমাঙ্কের নীচে জমাট বেঁধে যাওয়ায় একা সেই বেঁচে আছে গোটা পৃথিবীতে– দ্য লাস্ট ম্যান স্ট্যান্ডিং! কল্পবিজ্ঞানে এমন বিষাক্ত বেগুনির বর্ণনা অহরহ। আশঙ্কার আর অনিষ্টের তকমা ঝেড়ে ফেলতে বেগুনিকে অপেক্ষা করতে হবে সেই উত্তাল ছয়ের দশক পর্যন্ত– যখন সাইকাডেলিক আন্দোলন তার তুঙ্গে আর জিমি হেনড্রিক্স তাঁর গিটারে ‘পার্পল ডেজ’ বাজিয়ে ঝড় তুলবেন। ডিপ পার্পল ব্যান্ড তাদের মাথাঝিম সুরে জল আর আকাশে আগুন ধরিয়ে দেবে। এলএসডি-র নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা একটা গোটা প্রজন্ম তাদের দ্রশ্যবিভ্রমে চরাচর জুড়ে যে বেগুনি নকশা প্রত্যক্ষ্য করবে, সে বেগুনিতে এক হয়ে যাবে বিদ্রোহ আর নৈরাজ্যের রং!

…………………………………..

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

…………………………………..

বেগুনি এরকমই। ছকভাঙা। অতিপ্রাকৃত। ভবিষ্যতের রং। সে ভবিষ্যৎ-বিধ্বংসী হোক অথবা যৌথ মুক্তির। কিন্তু একটিমাত্র রঙের গায়ে এভাবে একাধিক বৈচিত্রময় তকমা জোটার দৃষ্টান্ত কি ইতিহাসে এই একটিই? বিজ্ঞানে হয়তো খানিকদূর ব্যাখ্যা মেলা সম্ভব। বিজ্ঞানীরা মনে করেন– বাস্তবে বেগুনি একটি আপাদমস্তক কাল্পনিক রং। রেটিনার কোন কোষে লাল আর নীল এই দুই তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ একসঙ্গে ধাক্কা খেলে সেই দুই তরঙ্গদৈর্ঘ্য মিলেমিশে মানবমস্তিষ্কে ‘বেগুনি’ নামক একটি তাৎক্ষণিক বোধটির জন্ম দেয়, বাস্তবে যার কোনও অস্তিত্ব নেই! গোটাটাই একটা কাল্পনিক নির্মাণ বই কিছু নয়! হয়তো সেজন্যই তাকে ইচ্ছেমতো বোধের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যায়! তাকে কোন চোখে দেখা হবে তা নির্ভর করছে যার চোখ সে রংকে চাক্ষুষ করছে, তার কল্পনাশক্তির ওপর। আর কল্পনা অনন্তপ্রসারী। মনে পড়ে, ইম্প্রেশনিস্ট আন্দোলন যখন চিত্রশিল্পের চালু ব্যাকরণকে বাতিল করে দর্শকের দেখার চোখকেই চ্যালেঞ্জ করেছিল, তখন এক তিতিবিরক্ত শিল্প সমালোচক পত্রিকায় লিখেছিলেন ‘দয়া করে মিস্টার পিসারোকে কেউ বোঝাবেন যে গাছের রং বেগুনি হয় না!’ কিন্তু পিসারো বুঝেছিলেন– হতে ক্ষতি কী? বেগুনি তো এরকমই! আর কল্পনার গাছের গায়ে তুলির আঁচড় বোলানোর জন্য একটা কাল্পনিক রঙের চেয়ে জুতসই আর কীই বা হতে পারে!

… পড়ুন বে নী লা-র অন্যান্য লেখা …

লাল নিয়ে লিখছেন হিরণ মিত্র: সাদা-কালো ক্যানভাসে একদিন লালের ফোঁটা পড়ল, আমার ছবি বদলে গেল তারপর

কমলা নিয়ে লিখছেন সুশোভন অধিকারী: সময় যখন সন্ধ্যা, তখন এক লহমায় চিনে নিতে পারি অনুচ্চারিত রংটি কী?

সবুজ নিয়ে লিখছেন মাধবেন্দু হেঁস: সবুজ মানে গাছপালা, বনজঙ্গল শুধু নয়, বরং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা জীবন, জীবিকা, স্মৃতি, প্রেম

The post বেগুনি রংটা বাস্তবে কোনও অস্তিত্ব নেই, গোটাটাই একটা কাল্পনিক নির্মাণ appeared first on Robbar | Sangbad Pratidin.


Viewing all articles
Browse latest Browse all 115

Trending Articles